শ্লীল/অশ্লীল, নান্দনিকতা, স্টিরিওটাইপ, ভূকাব্যিকতা:
শিরোনামে, গেঁটে-বাতও জুড়বো ভেবেছিলাম, সামলে নিলুম । ভেবেছিলাম একটা নিউট্রাল জায়গা থেকে শুরু করব – জাফর (বাহাদুর শাহ) বা গালিব (আসাদুল্লা খান) – মানে এর চেয়ে নিউট্রালি ভালো লাগার জায়গা বাঙ্গালির আর এক ঠাঁই – রবীন্দ্রনাথ, তা তিনিও আসবেন, ঘুরে যাবেন । প্রথমে কন্ট্রোভার্সিটি থেকেই শুরু হোক । একটা কবিতা – অবধারিত ভাবে পানু’র লেখা ।
হে মস্ত ও দুলন্ত শহর
কখনো ভাবিনি আগে
প্রকৃত ভোরের বেলা
শুধু ভোর বেঁচে থাকে
মানুষের মাথার ভেতর
ছেলেটি সাধারণ দেখতে, মেয়েটিও
মাঝখানে অনিশ্চিত ঘুরে বেড়াচ্ছিল – ভালোবাসা
মেয়েটি বলছিল – যদি কোন ঈশ্বর থাকে, তার বাস নির্ঘাত কোন শরীরের
অন্তঃস্থলে নয় – দুজনের মাঝের ভরাট শুন্যতায়
শুন্যতায় কে থাকে ? কার স্যাক্সোফোন
বেসমেন্টের জানলার ফাঁক গলে
তাজা রসুণ রুটির গন্ধ
ছেলেটি ও মেয়েটি এক পাক নেচে নিচ্ছে
ছেলেটি শুতে চেয়েছিল, মেয়েটি চায়নি
কামনা নিপাট ছিল – তবু
আমরা ভাবছিলাম,
ভাল হত যদি ওরা চুদত
তীব্র ও অনুকম্পাহীন
ভাল হত যদি ওরা চুদত
ঘরোয়া ও লাম্পট্যময়
আসলে ঝাঁপ দুরকম হয়
দৃষ্টির সামনে ও পিছনে
বৃষ্টি হয়নি
জলের গাড়ি ফুটপাথ ধুয়ে চলে গেছে
আমাদের প্রত্যেকের সামনে একটি স্টেশান চত্বর
মৃদু ও সবুজ ছাদ
লাল ও নিষেধী দেয়াল দরোজা
ফাঁদের মধ্যে কেবল আরো একটি ফাঁদ – এই বুনোট
আমরা যারা শুধুমাত্র একটি ঝাঁপের জন্য প্রস্তুত হই
ঘাড় গুঁজে টিউশানি পড়ি, অভিধান খুলে বার বার
ধাতস্থ হই – আর যাই হোক
ঝাঁপ শব্দটির নীচে পাতা অন্ধকার
অবিকল আগের মতন প্রগাঢ় ও প্রতিশ্রুতিময়
আঁতকে উঠে বন্ধ করে দেবার আগে, পুরোটা শুনতে জাস্ট একটা অনুরোধ করব, মাউস আপনার হাতে । ২০০৭-এর মাঝামাঝি পানু’র লেখা বন্ধ হয়ে যায় – রাইটার্স ব্লক, (মহাকরণের সাথে সম্পর্ক নেই) । হতাশ পানু নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে । লেখার জগত থেকে, বন্ধু বান্ধব থেকে । একদিন রাতে “বিফোর সানরাইজ” বলে একটা ইংরেজী সিনেমা দেখতে দেখতে লেখাটি আসে । পানু তার প্রিয় মঞ্চে লেখাটি তৎক্ষণাৎ শেয়ার করে । লেখাটি পাতে পড়তে না পড়তে জনগণ আঁতকে ওঠেন (অনুমান) ও প্রতিবাদে ফেটে পড়েন (প্রত্যক্ষ) – ছি ! ছি ছি ! লজ্জা করে না, শুয়োরের বাচ্চা ! মঞ্চ কলুষিত করতে এসেছেন, রাস্তার ভাষা নিয়ে রাস্তায় যান ইত্যাদি... প্রভৃতি ... কেউ কেউ মৃদু তিরষ্কার করেন এত সুন্দর এই লাইনগুলো, এর মাঝে একটা এরকম শব্দ ! এ-কী রুচি ?
বন্ধুরাও আসেন । শ্লীল। অশ্লীল নিয়ে এক তুলকালাম হয় । পানু কোন তর্ক না করে, মাথা নীচু ক’রে সরে পড়ে । পানু-কে জিগ্যেস করলাম -- কী পানু, উদ্দেশ্য কি ছিল ? বোম ফাটানো ? না-কী বহুদিন পিঠ সুড়সুড় । পানু বলল-- কোনটাই নয়, জাস্ট ওর থেকে
অ্যাপ্রপ্রিয়েট কোন শব্দ পাইনি । এক রাত্রে দুটি ছেলে মেয়ের সাক্ষাৎ, আলাপ, আকর্ষণ, সান্নিধ্য – পরের দিন সকালে দুজনেই চলে যাবে নিজের নিজের জায়গায় – পানু বলল ওরা চাইছিলো কিন্তু শারীরিক হতে পারছিল না – আমার মনে হচ্ছিল ওরা যদি একবার শুয়ে পড়ে তাহলে হয়ত দুটি তরুণ তরুণীর দীর্ঘ ভবিষ্যতের কোন যন্ত্রণা থাকবে না – দে মে গেট ওভার ইচ আদার অ্যান্ড মুভ অন । এত সংক্ষিপ্ত সময়, রাত শেষ হয়ে আসছে এই অবস্থায় যে কোন বিকল্প শব্দ – করতো বা শুতো (অনিশ্চিত যা বহু ক্রিয়াকে মীন করতে পারে), রমণ, গমণ, ভালোবাসাবাসি (এর সাথে “করা/ করতো” কে রেখে প্রলম্বিত করা), খাপ খায় না বলে মনে হয়েছিল । একমাত্র “চুদতো”-ই এই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ও অ্যাপ্ট । তো এখানে রুচি ম্যাটার করেনি বররুচিও নয় ।
প্রশ্ন হলো জনগণের কেন এই ইনহিবিশান ? (জীবনে ছেড়েই দিন) গল্পে, কবিতায়, সাহিত্যে পরকীয়া (বিবাহিত পিতৃবন্ধু কাকুর সাথে মনুমেন্টের মাথায় উঠে প্রেম করলেও অ্যাওয়ার্ড মেলে) বহুদিন বাঙালি ধরেছে, মরালিটির তোয়াক্কা নেই – তো মানুষ পরস্ত্রীকে রমণ, গমণ, প্রবেশ সব করতে পারে, কথ্য ভাষায় সমস্ত কিছু বলতে পারে আর নিজের বৌয়ের সাথে লিখিত ভাবে চুদতে পারবে না ? কেন এই ইনহিবিশান ? কেন এই কথ্য আর লিখিতের বিভেদ ?
পানু বিস্তর গবেষণা করিল – জ্ঞানী, গুণীর লেখা পড়ে বললো – বাঙালি তথা ভারতবাসীর মহারাণী ভিক্টোরিয়া নির্মিত মরাল কোড অফ কন্ডাক্ট (চন্ডীদাস/ ভারতচন্দ্র আপনারা মশাই যা-তা, কালিদাস তো অকথ্য – পানু অপেক্ষা পানু), আর বাঙ্গালির ক্ষেত্রে রাবীন্দ্রিক ভাষার চাপে, হুতোম, ত্রৈলোক্যনাথের (মুখোপাধ্যায়) ভাষার অপমৃত্যু – যদ্যপি অতিমানব রবীন্দ্রনাথ নিজের ভাষাটি নিজের লেখার জন্যই নির্মাণ করেছিলেন এবং মহীরূহ মাফিক অনুদার ছিলেন না । ত্রৈলোক্যনাথের ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া পরশুরামের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন – হুতোমেও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল । বাঙালি (পড়ুন আকাদেমি) রবীন্দ্রনাথ কে চিনলো না, সে নোবেল চেনে, তদুপরি বেল চেনে – ফলে কোন তলায় সুবিধে ... ইত্যাদী, প্রভৃতি...। আর এখন তো আনন্দ হি আনন্দ – সেখানে যা হবে তাই রীতি, তাই গীতি – পড়তে হয়, না পড়লে বিলা ! সেন্স অফ অ্যাস্থেটিকস পুরোপুরি বানিজ্য নির্ভর । প্রমাণ চান ? বকফুল উৎপাদন শুরু করুন, প্লেটে বকফুল, শ্লেটে বকফুল, তারায় তারায় বকফুল, জলসায় বকফুল, খোঁপায় বকফুল, ফ্লেবারে বকফুল – বকফুল কোম্পানি পিভিটি লিমিঃ, ডজন খানেক সাহিত্যিক ভাড়া করুন, রাজনৈতিক নেতাদের বকফুল খাওয়ান ( সঠিক মুদ্রায়) দশ বছরে লোকে বলবে – আহা বকফুলের মত গাল, বকফুলের মত চোখ, বকফুলের মত গলা ...
মানুষ ভয় পায় আইসোলেশান, আইসোলেশান নিরাপত্তায় আঘাত করে । নান্দনিকতার কোন সার্বজনীন সংস্করণ হওয়ার কথা তো ছিলো না । সে তো সাব্জেক্টিভ, তবু কেন সে সার্বজনীন ঐক্যের ধার ধারে ? বাণিজ্য ।
তো এইবার আসা যাক নিউট্রাল জোনে – অনুবাদ দিয়ে শুরু করা যাক – কারণ, অনুবাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য আক্ষরিক ভাবে অবজেক্টিভ প্রক্রিয়ায় একটি লেখার ভাষান্তর । কিন্তু সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের ভাষা আলাদা ! কেলোয় ফরসা ! পানু স্কুলে থাকতে একদা বাহাদুর শাহ জাফর অনুবাদ করেছে । এখন পানু পাড়ায় দাদা, মাথাটি একিরকম থাকলেও পানু এখন মাথা খাটায় না, মগজবাজি / মগজমারী করে । পানুর ভাষা এখন বুলি, তার পারমানেন্ট ঠিকানা পতলি গলি -- তো পানু’কে বললাম আর একবার পিছনে না তাকিয়ে অনুবাদ কর । তো পানু, ছাক্কা ৪৫ মিনিট ধরে লিখে কাগজ দিলো ।
বাহাদুর শাহ জাফর / ন কিসী কী আঁখ কা নুর হুঁ (ওরিজিনাল)
ন কিসি কী আঁখ কা নুর হুঁ, ন কিসি কে দিল কা করার হুঁ,
ন কিসি কে কাম আ সকে, ম্যয় ওহ এক মুশথ-এ-গুবার হুঁ ।
ম্যয় নহীঁ হুঁ নগমাঁ-এ জাঁ-ফিজা, কোই সুন কে মুঝ কো করে গা কেয়া ?
ম্যয় বড়ে বিরুগ কী হুঁ সদা, কিসি দিল-জলে কী পুকার হুঁ
মেরা রঙ রূপ বিগড় গ্যয়া, মেরা ইয়ার মুঝ সে বিছড় গ্যয়া,
জো চমন খিজাঁ সে উজড় গ্যয়া, ম্যয় উসি কী ফসল-এ-বাহার হুঁ ।
ন তো ম্যয় কিসী কা হবিব হুঁ, ন তো ম্যয় কিসী কা রকীব হুঁ,
জো বিগড় গ্যয়া ওহ নসীব হুঁ, জো উজড় গ্যয়া ওহ দায়র হুঁ ।
হম পর ফাতেহা কোই আয়ে কিঁউ, কোই চার ফুল ছিড়ায়ে কিঁউ ?
জাফর, আশক কোই বহায়ে কিঁউ, কে ম্যয় বেকসী কা মজার হুঁ ।
পানুর অনুবাদ (সত্যযুগ)
কারো আঁখিপাতে জ্যোতি নই আমি, কোনো হৃদয়ের শান্তিবাসর,
কারো প্রয়োজনে আসি নাই কাজে, শুধু এক মুঠি ধুলির চাদর ।
কোনো অপরূপ গুঞ্জনরেশ, নই আমি নই, কী হবে শুনিয়া ?
আমি শুধু এক ক্রমার্তনাদ, প্রসবিত হই কলিজা পুড়িয়া ।
আনন জ্যোতি, প্রিয়মুখ যত, আঙ্গন ছাড়ি হারায়ে গিয়াছে,
আমি ঝরাফুল বসন্ত বনে, যে বনে বাহার বিদায় নিয়াছে ।
কোন হৃদয়ের হৃদয় নই গো, কোন শত্রর দুশমন ঘোর,
আমি বিমূর্ত দগ্ধভাগ্য, স্পন্দনহীন, মৃত সরোবর ।
কেউ কেন দিবে দু’টি ঝরাফুল, অশ্রু অর্ঘ্য আমার শিয়রে,
অসহায়তার ইতিহাস হয়ে, জাফর মুছিবে কালপ্রান্তরে ।
পানুর অনুবাদ (ঘোরকলিযুগ)
কারোর চোখের রোশনি নই বে
বুকের শান্তি
কারোর কাজে লাগিনি , শালার
ধুলোর মুঠঠি
জান ভ’রে দেয়া মিউজিক নই
শুনবে কে বাপ !
ফাঁকা গাম্বাট আওয়াজ, পোড়া
কলজের ডাক
থোবড়ার ফ্রেশ, ইয়ারের ফেস
লোপাট হয়েছে
শুখা ফুল আমি, ফাঁকা বাগানের
ইয়ের নীচে
কোনো হারামীর দুশমন নই,
জিগরি ইয়ার
ফুলস্টীম-- পোড়া কপাল, শুকনো
নদীয়া’র পার
কোন রঙ্গিলি ফাতেহা পড়বে
আমার কবরে ?
ফুল দেবে শালা জাফরের, ক’টা
হোপলেস হাড়ে ?
(দ্রষ্টব্য ; লাস্ট দু’লাইনে পানু “ এই হোপলেস গাঁড়ে” লিখেছিল, আমি “হাড়ে” করলাম, যদিও পানুর বর্তমান ভোক্যাবে হাড্ডি আছে, হাড় নাই – নান্দনিকতার খাতিরে, মানে, আত্মীয় স্বজনের নান্দনিক ভ্রুকুটির কোপে, রবীন্দ্রনাথকেও এককালে “ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো / আমার বুকের বসন খানি” কেটে “মুখের আঁচল খানি” বসাতে হয়, যদ্যপি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে মহিলারা হাসাহাসি করেন, অ্যাস সাচ মুখে আঁচল থাকে না, থাকলেও সেটা ন্যাচারাল পোজ নয়, তদুপরি, হাতে ধরে থাকার জন্য ওড়া বেশ দুষ্কর – বুকের বসন সেখানে উড়ে যাওয়া— বলাকার মত অনায়াস ঝামেলাবিহীন । তথাপি... ইত্যাদি, প্রভৃতি...)
পাঠক, আর একবার রেগে ওঠার আগে মনে করিয়ে দিই –অশ্রদ্ধা উদ্দেশ্য নয়, জাস্ট ওয়ান্ট টু মেক আ পয়েন্ট ।
এবার আরেকটা সিনারিও – এবার গালিব – গদাই, কলকাতার বিজয়গড় অঞ্চলে থাকেন । সবে এক জেনারেশান বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, গদাইয়ের পাড়া পড়শী, বন্ধু, বান্ধব যে ভাষায় কথা বলেন সে ভাষা এখনো বাংলাদেশের ছোঁয়া বজায় রেখেছে –
গালিব ( ওরিজিনাল)
হরেক বাত পে কহতে হো তুম
কে তু কেয়া হ্যায় ?
তুমহি কহো --
ইয়ে অন্দাজ-এ-গুফতগু কেয়া হ্যায়
রগোঁ মে দৌড়তে ফিরনে কি
হম নহী কায়ল
জব আখোঁ সে ন টপকা তো ফির
লহু কেয়া হ্যায়
অনুবাদ (গদাই লস্কর)
হগল কথায় জিগাও – তুমি কে-ডা
তুমিই ক’ও
এ কী ধরণ কথার ?
শিরার মইদ্যে হুলুস্থুলুস-- দিগবিদিকা সোটে
(তারে) খুন কই না মোটে
চক্ষু দিয়া না’ই যদি বয়
রক্ত সে-ডা ?
--
কী পানুর কলিযুগের অনুবাদ পড়ে ব্লাড বয়েলিং, আর গদাইয়ের অনুবাদ পড়ে কমিক কমিক ফূর্তি হচ্ছে তো ? জজসায়েব – দিস ইজ স্টিরিওটাইপ । ভাষার নয়, মাথার । রকের ভাষায় বাওয়াল হবে, তার নান্দনিকতা থাকার অধিকার নেই । ভানু বন্দোপাধ্যায়ের সুবাদে বাংলাদেশের কথ্য ভাষা কমিক ছাড়া আর কিছু নয় । পুরুলিয়া / বাঁকুড়ার ভাষায় বড়জোর গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি করার মত মানুষের দূরবস্থা, দৈন্যর প্রকাশ সম্ভব । ইন্টেলেকচুয়াল / নান্দনিক কিছু লিখিত ভাবে রাবীন্দ্রিক বাংলা ছাড়া মহাপাপ ।
এবার সত্য নান্দনিক টেরিটোরিতে একটু ঢুঁ মারা যাক । পানুর আলম বালম ছেড়ে, ভূকাব্যিকতায় । সেই ছোটবেলায় পড়া – পশুকে বন থেকে তুলে আনা যায় কিন্তু তার মন থেকে বন তুলে ফেলা যায় না । রবীন্দ্রনাথ, জীবনে ৫০ বার অন্তত তুষারপাত দেখেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেক দেশে কিন্তু তাঁর কোন কবিতায় সেই সব দেশের সেই সব অনুষঙ্গের কোন ছোঁয়া নেই, সেখানে শুধুই বাংলার মুখ – এ অভিযোগ আমার নয়, অকুন্ঠ রবীন্দ্রানুরাগী সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেবের । আমার ব্যক্তিগত মতে, যদি রবীন্দ্রনাথ তা করতেন তাহলে হয়তো আরো কিছু অনন্য সৃষ্টি বাংলাভাষায় হতে পারত (আমার ব্যক্তিগত মতে বাংলাভাষায় আজো রবীন্দ্রনাথ সর্বাপেক্ষা মেধা/ মণীষার কবি – তাঁর ভাষা প্রতিষ্ঠিত হলেও রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় তাঁর মননের উত্তরাধিকার খুব বিক্ষিপ্ত ভাবে কদাচিৎ চোখে পড়ে – এ দুঃখ যাবার নয় ) । তো, অমিয় চক্রবর্তী শুরু করলেন সেই ধারা (অমিয় চক্রবর্তী আজো সেই হাতে গোনা প্রাসঙ্গিক কবিদের একজন, যিনি কিছুটা হলেও উত্তর রাবীন্দ্রিক কবিতায় স্বতন্ত্র মনন ও দর্শনের দাবী মেটাতে সক্ষম বলে মনে হয় ) ।
“সাক্ষাৎ সন্ধান এই পেয়েছো কি ৩-টে ২৫-এ ?
বিকেলের উইলো-বনে রেড অ্যারো ট্রেনের হুইসিল
শব্দশেষ ছুঁচে গাঁথে দূর শুন্যে দ্রুত ধোঁয়া নীল ;
মার্কিন ডাঙার বুকে ঝোড়ো অবসান গেল মিশে ।।
অবসান গেল মিশে ।।
(ওক্লাহোমা; অমিয় চক্রবর্তী)
একটা রেশ থেকে গেলেও এই প্রথম পর্যায়ের ডায়াস্পোরিক ভূকাব্যিকতা ভ্রমণের ছোঁয়া মুক্ত নয় । এক ট্যুরিস্টের জবানী বলে মনে হতেও পারে ।
আর একটা কবিতা পড়ি –
বন (আর্যনীল মুখোপাধ্যায়)
জুতোর দোকানের সামনেই বনের বর্ণনা জুতো আঁটতে আঁটতে
আমাদের পাহাড়ী সেলুন থেকে চুল কাটার মাঝখানেও নিচের বনানী
বাড়ীর পেছনে ও জন্মদিনে বন, বিবাহবার্ষিকীতেও
বন থেকে বেরুলো ছেলে
বনের ছাতি ফাটিয়ে ফেলে
বিমর্ষতা কাটানোর যেখানে একমাত্র বেঞ্চ
সেই চুড়ো থেকেও নিচে নদীর দুপাশে বনমাথা
ভেবে দেখেছি কতগুলো বনের রূপক !
হাঁটতে হাঁটতে পড়লো “অ্যান্ডারসন হাঁটাপথ”
লাল শেয়ালটা হঠাৎ স্থাণুবৎ জুড়ে চোখের মণি
তার সাথে চোখের চেনাচিনিতে নতুন ভাষা হলো
জিম শুনে আকর্ণ হাসে, আহ্লাদ করে
এবছর তাহলে কম হরিণেরা লাল শেয়ালের কারণেই
ভালো হলো ! ওর বাগান জিম সদ্য পয়েন্সেটিয়া লাগিয়েছে
প্রথম দু’স্তবক বর্ণনার “ভেবে দেখেছি কতগুলো বনের রূপক ! “ বাদ দিলে । বাঙালি সত্তাও পূরোদস্তুর –
বন থেকে বেরুলো ছেলে
বনের ছাতি ফাটিয়ে ফেলে
তাই টুরিস্টের কলমে বলে মনে হওয়াও থেকে যায় । প্রকৃত ভূকাব্যিকতা ধরা পড়ে শেষ স্তবকে, বাঙ্গালির চির নান্দনিক হরিণ, আদ্যন্ত রোমান্টিকতার হরিণ – তার সংখ্যা কমে যাওয়ায় কোন খেদ নেই বলে । বাঙ্গালির হরিণ তো আর নুইসেন্স নয় ।
কাল রাতে আর্যনীলের সাথে কথা হলো – ও বলল এরকম তো ভেবে লিখিনি । অটোমেটিক এসেছিল । এই অটোমেটিক চলে আসাই স্বতস্ফূর্ত নান্দনিক বদলের, পালা বদলের । ভুলবেন না সেখানে এক আদ্যন্ত বাঙালি বেড়াও রয়েছে “ বন থেকে বেরুলো ছেলে/ বনের ছাতি ফাটিয়ে ফেলে ।
পুনশ্চ ; কিছুক্ষন আগে অর্ঘ্য কমেন্ট করলো -- আর ভূকাব্যিকতার পাঠক বাঙলায় কয়টা তৈরি হতে পেরেছে ? বাঙলা কবিতা পড়লেই আমাদের সাহিত্য প্রতিবেদকরা এবং মহামান্য আলোচকেরা সবার আগের নিজেদের প্রশ্ন করেন - এই কবিতা বাঙ্গালীর আর্থসামাজিক অবস্থা, বাঙালীত্ব, লোকসাহিত্য ইত্যাদি ইত্যাদির কোন দিক উপস্থাপন করছে? এই কবিতা কি 'আমাদের' কবিতা? - "জিওপোয়েট্রি" ওইখানেই বাদ ।
(থ্যাঙ্ক ইউ অর্ঘ্য – এই পয়েন্ট-টা লেখার আগে মাথায় ছিল না । )
পানুর মনে হলো – হায় কবিতা – তাহলে বাঙ্গালীর নিজস্ব কুয়োর দলিল ছাড়া, ব্যবহারিক জীবনের উপযোগীতা ছাড়া তুমি নেই ।
“জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি
জুটে যায় যদি দুইটি পয়সা
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী”
(হজরত মুহম্মদের বয়ান ; সত্যেন দত্তর তর্জমায়)
ব্যবহারিক বাঙালি, ফুলটি কোন ফুল বাংলার ফুল কি-না, সেই নিয়ে চিন্তায় থাকতে পারেন । আবার শেষ লাইনে তবে “বাধাকপি কিনো, হে অনুরাগী” বসিয়ে নিতে পারেন, চিবোবার জন্য ঠিক, পুষ্টিকর ও প্রচুর গ্যাসবর্ধক । তবে যে তরি তরকারি পাতে পড়ে স্যার একবার অভিধান খুলে দেখে নিয়েন তা দেশীয় কি-না ! যা শুনেছি, আলু বেগুন সবই বিদেশী । জাত না যায় !
যাই হোক বাঙ্গালির ব্যবহারিক/ বাণিজ্যিক মূল্য ছাড়া তাহলে নান্দনিকতাও হাওয়া । নন্দনতত্ব গরুর খাদ্য মাত্র । গরু, গোবর ও ঘুঁটে এই তিন বাঙ্গালির নিজস্ব দেশীয় । বেশ পরের বার মরোপোয়েটিক্স, গোবর ও ঘুঁটে নিয়ে আলোচনা করা যাবে ।
"বাধাকপি" :-D
ReplyDeleteমারাত্মক
হ্যা, বাঙলা কবিতার পাঠক অদ্ভুত হতে পারে। ওই "অটোমেটিক আসার"-ভিতর যেভাবে প্রচলিত ভাবে 'কবিতা' খোঁজা হয়, সেভাবে কবিতা খুঁজে পেতে প্রস্তুতি লাগে,তারো আগে লাগে মনে হয় এক ধরণের মানসিক মুক্তি, তা নাহলে কবিতাটাই 'খোজা' হয়ে ধরা পড়ে। আমাদের সেই প্রস্তুতি যেন খুব কম। অথচ গড়পড়তা 'চমক'-এর দারুণ রসিক আমরা। গ্রিক পুরাণ লেখার মধ্যে যত্র তত্র গুজে দাও, পাঠক খুব ভাল পাবে। 'কুইবেক রমনী' দারুণ সফলভাবে ব্যবহার করে ফেলবেন এমন কবিতালেখক যিনি কোনওদিন মালটার ৬,৬৩৮ মাইলের ভিতরে আসেন নাই। কবিকে হয়তো দোষ দিয়ে লাভ নাই, বরং তার কল্পনাশক্তির তারিফ, কিন্তু কল্পনা করে লেখা, আর ওই "অটোমেটিক ভাবে" চলে আসার ভিতর অনেক ফারাক। অথচ কবিতা পাঠের বড় স্পেক্ট্রাম চিন্তা করলে, নেট ফল উল্টা। আবার এর বিপরীত চিত্রও দেখেছি। বহু বছরের প্রবাসী এক কবিকে চিনি যিনি ভৌত জীবনানন্দে তিনটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন।