Sunday, July 19, 2015

গোয়েন্দা গল্প



লাউমাচার পেছনে সূর্য ডোবে গোয়েন্দা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন তার আভা মাটি ফুঁড়তে ফুঁড়তে ঢুকে যায় তামাশারঙ্গা কেঁচো গোয়েন্দা দেখেন নীহারিকা অব্দি তাঁর দৃষ্টি তদারক করে ছায়ার নোনা হাওয়ায় দৌঁড়ে যাওয়া মানুষ বিস্মিত করে তাঁকে হাতে চায়ের মগ তুলে নিতে নিতে তিনি তারও তদারকি করেন দূরে বন্দরের আলো মুখে বসন্তের দাগওলা মানুষেরা তাস পেটায় এনামেল একটা প্রতিধ্বনি জলের ভেতরে ডোবে গোয়েন্দা মানুষের ধর্মের কথা ভাবেন গোয়েন্দা বোঝেনঠিক যেখানটায় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যায় মানুষ, সেখানটাই মানুষের অবস্থানযা ক্রমে স্বপ্নে চেতনে সহজাত হয়ে ওঠে  

কামিনরা চুন গুলছে ক্যানেস্ত্রায় ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে গোয়েন্দার চায়ের লিকারে ফোঁটা ফোঁটা শাদা সময়এবড়োখেবড়ো দাঁতের ওপর হলদে হয়ে আসা সময়শীতের ভোরে হাইড্রেন্ট দিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া সময় বেরিয়ে আসছে মিশতে চাইছে আস্তে সুস্তে বড় হয়ে ওঠা আবহাওয়ায় গোয়েন্দা জানেন  এক সময় আর অপর সময়ের জোড়ের চিহ্নটুকুই বিপন্নতা গোয়েন্দা এই চিহ্নের তদারকি করছেন মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চোখ রেখে দূরত্বের কথাও ভাবছেন

গোয়েন্দা জানেন, অস্তিত্ব মানেই প্র্মাণসাপেক্ষ হতেই হবে এমনটা নয় গোয়েন্দা বোঝেন, বিভ্রান্তিই একমাত্র অনুমেয় পদ্ধতি সুক্ষতার ভেতর যখন গুটিয়ে আসে সুক্ষতার ধারণাটুকু, স্থুল না হলে তাকে কেউ আর বুঝে উঠতে পারবে না গোয়েন্দা জানেন তাঁর আত্মজীবনীর মধ্যে সুক্ষ সমস্ত অপমানের কথা লেখা থাকবে, উষ্ণ অসোয়াস্তি বা শীতল মরচে, সমস্ত কথাই যথাস্থানে পৌঁছে দেয়ার বন্দোবস্ত থাকবে

অনেক রাতের ট্রেন থেকে নেমে পড়ছে সে ইন্দ্রিয়ের মত বস্তুর মত গোয়েন্দা অনুসরণ করছেন তাকে বালির বস্তার মধ্য দিয়ে, মৃদু ট্রেঞ্চের মধ্য দিয়ে, অন্ধকারে উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির জানলা দিয়ে ফেলে দেয়া কুচি কুচি চিঠির মধ্য দিয়ে বেমানান হয়ে উঠছে তার ফেরা গোয়েন্দা অনুসরণ করছেন তার ফেরাটুকুযেন-বা কোথাও কারো যাওয়ার ছিল না   

যতই এড়িয়ে যেতে চান সূত্র গোয়েন্দাকে ছেড়ে উঠছে না যোগাযোগ একটা হয়েই যায়, অপরাধের সাথে, আলু পটলের ডালনার সাথেও একটা যোগাযোগজিরে আদাবাটার ভেতর দিয়ে কামের মধ্য দিয়ে হাতের তারে অন্তরা টপকে যাওয়া একটা স্তব্ধতাও মানুষকে পেয়ে বসতে চায়ক্রিয়ার থেকে কর্ম খসে গেলেও সে আর কিছু না হোক গ্যারোটি হয়েই মানুষের গলার দাগে ঢুকে যেতে চায়যোগাযোগ হয়েই থেকে যেতে চায়

গোয়েন্দা গভীর তাঁর পায়ের কোন শব্দ হয় না তিনি খিচুড়ির প্লেটে ভাজা মাছটির উল্টোদিক থেকে চেঁছে নেন খিচুড়ির কণা, সময়, দেশি মদের দোকান গোয়েন্দা গভীর তিনি পূর্বপুরুষের পায়ের আওয়াজ টের পান গোয়েন্দা জানেন, গভীরতা মানুষকে সংকুচিত করে আকারে, আকাঙ্ক্ষায় ফলে একশো চল্লিশ বর্ণের ট্যুইটারও তাঁর গায়ে ঢলঢল করে ভাজা মাছের থেকে সরে ঢুকে পড়েন তিনি শুকনো লঙ্কায়, তেজপাতায়, দানা দানা মালকামুসুরে চোখে চশমা তুলে নেন নোটবুকে মাছের দাম টোকেন প্লেট থেকে তিতপুঁটি ঝাঁপ দ্যায় জলে

গোয়েন্দার মধ্যবয়স দুদিনের না কামানো দাড়ি, চিবুক কানের কাছে শাদা বিছানার পাশে গোয়েন্দার উঠতি যৌবন তার ভেতরে বসে গোয়েন্দা লেখেনচাঁদের কলার ধরে জেরা কর, বাঞ্চোত, জোসনা কোথায়? বিছানায় মাঝবয়েসী গোয়েন্দা, মৃদু হেসে পায়ের ওপর চাদর টেনে নে্ন আসলে বয়েসের সাথে, তার নড়াচড়ার সাথে চক্রবালকেও অ্যাডজাস্ট করে নিতে গোয়েন্দা জানেন গোয়েন্দা জানেন শূন্যতাকে ঠিক ডিগ্রি আর হেলিয়ে রাখতে হবে, অতীত ভবিষ্যতের মধ্যে ক্রমে দ্রুত হয়ে ওঠা পেন্ডুলামকে জায়গা করে দিতে

তার গন্ধ ট্র্যাপড হয়ে আছে বরফের মধ্যে আটকে পড়া বাতাসে-- সেই ফুল সেই দেহ তবুও মানুষ অপেক্ষা করে বরফের ভেতর দিয়েও একটা শ্বাসের ওঠার, উঠে নামার শ্বাসরুদ্ধ এই প্রতীক্ষার মধ্যে দুএকজন আবহাওয়া নিয়ে কথা বলে, গেলাস ঠিন করে ওঠেগোয়েন্দাও কর্ক খুলে ঢেলে নেন, আলতো চুমুক দেন, অথচ তাঁর চোখ নিবদ্ধ থাকে কার্বন ডেটিং-এর রিপোর্টে  গোয়েন্দা বোঝেন, আমাদের মাথার ওপরের ছাদ, চার পাশের দেয়াল সবকিছু, সমস্তসব, প্রশ্ন দিয়েই তৈরী গোয়েন্দা হাতের গেলাস ঘোরাতে ঘোরাতে কোটের ল্যাপেলে হাত রেখে হেঁটে যান সেই প্রান্তসীমার দিকে, সেই জলের মাঝখানে সমাপ্ত হয়ে যাওয়া পয়েন্টের দিকে, যেখানে যাওয়া ফেরার পথ দু শেষ হয়ে গেছে গোয়েন্দা সেখানে দাঁড়িয়ে খোঁজ খবর নেন তাঁর  ড্রয়িং রুমের, লনেরযা তুষারের নীচে ছাড়াছাড়া হরফ হয়েই রয়ে গেছে


২৪ ইঞ্চি রিইনফোর্সড কংক্রিট এই পথে গোয়েন্দা বিশ্বাস রাখেন বিশ্বাস যে পথ দিয়ে মানুষকে সুনিশ্চিত করে নিয়ে যায়, গোয়েন্দার আস্থা সেখানে ফুরিয়েছেতাও বহুদিন হল শূন্য এক পবিত্রতার মধ্যে বন, পাহাড় দাউদাউ করে মানুষের বসতির গন্ধ ধীরে ধীরে ঢুকে যায় লেবুঘাসে, ইতস্তত স্যালভিয়ায়এক লোহার দোলনায় দ্বন্দ্বের মধ্যে দুলতে দুলতে গোয়েন্দা দেখতে পান-- মানুষ তার শীর্ণতা নিয়ে আলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আলোতে মানুষের ছায়া ধীরে প্রত্যয়ে শেষ হয়ে আসছে

১০
পাথরের ফাটল থেকে উঠেছে, চারা, সাদা গোলাপের বুনো ফল মুয়াজ্জিন আসছেন ত্রস্ত পায়ে, ফজর ডাকছে গোয়েন্দা ঘাসের ভেতর থেকে এসমস্ত দেখেন, গোলাপ ফলের ভেতর থেকেগোয়েন্দা দেখেন, অবসাদ ঘুরে বেড়াচ্ছে বাতাসে, অক্ষর হয়ে, বাক্য হয়ে, জমাট বাঁধছে ভেঙ্গে উঠছে, গাছ ছেঁকে নিচ্ছে সেই সব অবসাদ, তাকে উপযুক্ত কার্বন করে নিচ্ছে গোয়েন্দা জানেন মানষের স্বভাব, তার আত্মপ্রবঞ্চন-- সময়ে সময়ে কব্জির শিরা অব্দি কাঙ্খায় দপদপ করা কাঁচের টুকরোকে নিয়েও সে রিফাইনমেন্টের কথা ভাবে, হীরের কথা ভাবে, দুটো-একটা কবিতা লিখে উঠতে পারে গোয়েন্দা জানেন মুহূর্তই সব-- মুহূর্তই জানে খুনীর চেহারা জলরঙ্গের মধ্যে দিয়ে কীভাবে আচমকা স্বচ্ছ হয়ে যায়শ্যাওলার নীচে পাথরের খাদ্য হয়ে থেকে যায়

১১
মাংস শেষ হয়ে যায়, তার প্রতিভাও শেষ হয়ে যায় ক্যানের ভেতর থেকে পুরোনো চর্বি খুঁটে খুঁটে তোলেন গোয়েন্দা, জিভে রাখেন স্টিলের পাত্রে জল ফোটে, জলের ভেতর চর্বির আভাস, গোয়েন্দা তাতে এক চামচ চা পাতা ঢালেন পরিবর্তন একটা ধারণা, বস্তুর, বস্তুর দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকা চোখের আসলে সমস্ত বদল বস্তুর আড়ালেই, চোখের আড়ালেই ঘটে অন্তে মানুষ শুধু চেখে নিতে নিতে, রেট্রোস্পেক্টে বুঝতে চেষ্টা করে কোথাকার প্রচল, কোথায় গিয়ে অন্য হয়েছে

১২
পর ও অপর, এরই মাঝে সূত্রগুলো রাখাআপন বলে কিছু নেই প্রমাণের কুচি উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘটনাস্থলে, মানুষের নৈতিক ও কানুনী প্রক্রিয়াগুলোর ফাঁকে ফাঁকে মৃত্যু কে মেনে নেওয়া মানে জীবনকে মেনে নেওয়ারকমই গোয়েন্দা ভাবেন বাইরে থেকে ভাবেন ঘটনা মানুষকে ফেলে চলে যায় অন্য একটা পরিণতির দিকেঅথচ মানুষ তাকে আজীবন করে রাখে, ইচ্ছে বা অনিচ্ছেয় প্রাণ করে রাখে তার গলায় ওয়াটার বটল বেঁধে দিতে ভুলে যায় না কখনো

১৩।

শিরদাঁড়ার ভেতরে কখন একটা দেওদার চাগিয়ে উঠলো? কে পুঁতে গেল তার বীজ? আপনি বলতেই পারেন, এরকম প্রশ্নের সামনে মানুষ সচরাচর দাঁড়ায় না। কিন্তু হত্যার সামনেই বা ক’জন দাঁড়ায়-এমনকি খুন হতে হতেও? গোয়েন্দা দেখতে পান, খুনের দৃশ্যে, উষ্ণ বাতাস আটকে থাকে মুখের ভেতরে, পচে গলে যাওয়া এক অনন্তের সামনে মানুষ শ্বাস ফেলতেও ভুলে যায়। শিরদাঁড়ার ভেতরের সীডার কেবল তার শিকড় চারিয়ে দেয় হত্যার মধ্যে। মানুষ একদিনের জন্য বেঁচে ওঠে। নাকে ভিক্সের গন্ধ নিয়ে সে কফিশপের ভেতর জেগে ওঠে, তার কফি কাপের মধ্যে দারুচিনির সুবাস...যে সুবাসকে তার ঘ্রাণকেন্দ্র চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলছে।

১৪।
খুনী চলতে চলতে থামেন, পিছন ফিরে আমাদের গ্রহকে দেখেন ও এগিয়ে যান। বেড়ার ও’পারের আভা কুসুমহলুদ, যেন আজ এক নতুন বদল আবিষ্কার হবে। বা বদল আবিষ্কার করবে তাকে। গির্জার রেলিঙ্গে হাত রেখে খুনী তাকান মিনারের দিকে। তিনি দেখতে পান জল ঝরছে। চুনাপাথরের মধ্যে দিয়ে পরিস্রুত হয়ে আসা জল। যা সিঁড়িতে তাঁর পায়ের মিনারেল মুছে ফেলছে।


১৫।
চোখের ভেতরে সাঁতরে বেড়াচ্ছেন খুনী। মৃতর চোখের মধ্যে পাড় নেই। শুধু উৎসেচকগুলি ভেঙ্গে যাওয়ার আগে শেষবারের মত তাকিয়ে থাকে উপাচারের দিকে। মানুষের রক্তের মধ্যে খুনীই জায়মান থাকে কখনও ফুলকি হয়ে কখনো তুষারক্রিস্টাল হয়ে। সে রক্ত ধমনী বা শিরার হোক, অথবা বেডরুমে কার্পেটের ওপর, আয়নার কাচে, পোর্সিলিনের ভাসে, মোরামে পাথরে। গোয়েন্দা বোঝেন ক্ষত মানুষের ভেতরেই থাকে, রক্তের ভেতরে বসে শুধু তাকে জাগিয়ে তোলা-- এটুকুই খুনীর সমস্ত।  

১৬।
তিনি জানেন না আজ কার ধুলো তাঁর ওপর নেমে আসবে। প্রত্যয় মানুষকে পাথর করে তোলে। তার ওপর আলো আছড়ালে, শিরায় অভ্র ছলকে ওঠে। আলো মানুষকে একে অপরের প্রতিফলন করে তোলে। কাতারের মধ্যে দাঁড়িয়ে যারা পরস্পরের মধ্যে নিজের মুখ দেখতে পেয়ে স্বস্তি পায়।  খুনীর সমস্ত নির্মাণ আলো থেকে দূরে। প্রত্যয় থেকে দূরে কাঁপা-কাঁপা হাতে তিনি তুলে নেন মদের গেলাস। তিনি জানতে চান না আজ কার ধুলো তাঁর ওপর আছড়ে পড়বে। খুনী কেবল পদ্ধতিকে জানেন, তিনি জানেন আজ তাঁর মোডাস অপারেন্ডি আগের বারের চেয়ে পৃথক হতেই হবে। তিনি শেষ মুহূর্তে কলম তুলে নেন, ভারী অপ্রস্তুত হয়ে কলম তুলে নেন…