Saturday, August 9, 2014

আজকের ভাবনা


অগাস্ট ৯, ২০১৪

 

সবাই ব্যস্ত। আমি আমার নিজের কাজ করতে থাকি, এমন ভাবি। আজ থেকে এখানে কিছু সাপ্তাহিক ভাবনা লিখে রাখবো এমন ভাবি।


সহলিপি প্রসঙ্গে প্যাটের সাথে কিছু কথা হয়েছে। এমনও ওকে বলেছি যে শুভ্র রাজি থাকলে আমরা বিওলেতা মেদিনাকেও এই আলোচনার অংশীদার করতে চাইবো।  



আমাদের দুজনের কেউই আকাদেমিক নই। যেমন গোটা বাংলা কবিতাই। আকাদেমিক প্রায় নেই। আর যারা নামে আকাদেমিক তাদের কাজকম্মের চেহারাও দুর্ভিক্ষপীড়িত। দিশি ও তার চেয়ে অনেক বেশি বিদেশী কেতাব অন্ধবিশ্বাসে মুখস্থ করে ফেলা। সাহিত্যের সাথে রাজনীতিকে চিনতে ও মেলাতে না পারা। এবং সংবাদপত্র ও হৃষ্টপুষ্ট কিছু প্রকাশনী প্রচলিত বানিজ্যিক সাহিত্যের গবেষণাতেই আটকে থাকা। আটকে থাকা কেননা তার বাইরেটা অজানা। জানলে হয়তো আটকাতেন না অনেকে। কিন্তু জানেন না কেন? সে বড়ো জটিল প্রশ্ন। 
 

পশ্চিমেও অনেক সমস্যা আছে যাকে সমস্যা ভাবাও হয়না কেননা বাহিরি দৃষ্টিটাই পাওয়া যায় না। বাংলার আকাদেমিকের একটা প্রতিভাবনার জগত আছে, পশ্চিমের তা নেই। বিশেষত আমেরিকায়। সাহিত্য অতি-প্রগতিশীল, গবেষণাধর্মী ও পরীক্ষামূলক বলে মনে করা হয় এ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারও যে একটা প্রতি-ধারা থাকতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ও যে ক্ষমতার আধার হয়ে উঠতে পারে এবং হয়, বিদেশ ও বিদেশী শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধে কৌতূহল ও জ্ঞান অতিসীমিত হবার ফলে যে সেখানে অনবরত গুরুচন্ডালিকা হচ্ছে, এ সম্বন্ধে সচেতনতা কম। এখানেই আমরা। একজনের পেশা কারিগরি গণিত, বড়ো পশ্চিমী কর্পোরেশনে প্রায় স্বতন্ত্র গবেষণা ও উন্নয়নের কাজে যুক্ত, অন্যজন স্বাধীন সমাজকল্যানের কাজে ব্রতী এক উপদেষ্টা বা কনসাল্টান্ট হিসেবে ।


প্যাট বলছে যে তার পক্ষে সহলিপির ভাবনাক্ষেত্রে  ethnographic writing বা নৃকুলিক বা নৃকুলবিদ্যক  লেখার কথা নিয়ে আসা স্বাভাবিক। ও স্বচ্ছন্দের।  বহু অর্থ ও জ্ঞানশাখার মধ্যিখানের কোনো একটা জায়গায় থাকে নৃকুলিক রচনা। ক্রমশ এইভাবেই তাকে দেখা হয়েছে হয় ৪০-৫০ বছর। এখন আরো বেশি অর্থে। এবং যাঁরা নৃকুলবিদ, তাদের অনেকেই নিজেদের রচনা ও আগ্রহের ময়দানে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, বিজ্ঞানের দীর্ঘ ছায়া লক্ষ্য করে চলেছেন অনবরত।


       ‘সহলিপির কথা না হয় আর একটু পরে আসুক, মূল যে পরিবিষয়ী কবিতালিপি, সেখানেও কিন্তু নৃকুলিক রচনাবৃত্তির একটা বড়ো জায়গা আছে। প্যাট যেসব কথা জেমস ক্লিফর্ডের একটা ১৯৮৩ সালের প্রবন্ধপাঠের ভিত্তিতে বলছে এবং জোর দিচ্ছে সেটা এই যে অভিজ্ঞতালব্ধ (experiential writing  ) লেখা একসময় এখানে ব্যাখ্যামূলক বা অর্থ-সংবাহী (interpretive writing ) হয়ে উঠছে।


       এ প্রসঙ্গে দুটো কথা আপাতত। ভাবনার এই শনিবারী খোরাকি হিসেবে। প্রথমটা একটা উদ্ধৃতি রোলাঁ বার্থের। বার্থ ৬০-এর দশকে বলছেন Interdisciplinary work, so much discussed these days, is not about confronting already constituted disciplines (none of which, in fact, is willing to let itself go). To do something interdisciplinary it’s not enough to choose a “subject” (a theme) and gather around it two or three sciences. Interdisciplinarity consists in creating a new object that belongs to no one.”


          দ্বিতীয়  কথাটা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে অনেকদিন আগে বলেছিলো উৎপল কুমার বসুর কবিতা সম্বন্ধে। এই যে প্রশিক্ষণে যিনি জিওলজিস্ট বা ভূতাত্ত্বিক (উৎপলদা ও শান্তনু, দুজনেই) তার মধ্যে একটা মাঠে নেমে পর্যবেক্ষণ করার ব্যাপার আছে। পর্যবেক্ষণ করে, মাপজোক করে, উপাদান যার মধ্যে তথ্য ও উপাত্ত দুই both information and data ফিরে আসে এবং চিন্তা, ভাবনা, বিশ্লেষণের প্রায় সবটাই হয় পরীক্ষাগারে। কবির ক্ষেত্রে খাতায় বা পর্দায়। উৎপলদার কবিতায় এটা ব্যাপক পরিমাণে। তবে এইভাবে খুঁজে দেখা, পরখ করে, ও বিশ্লেষণ করে দেখার মধ্যেও যে ফাঁকি ঢুকে যায়, অসম্পূর্ণতার অনুভব ও উপস্থিতি থাকতে পারে এই অনিশ্চয়তাকে প্রতিষ্ঠা করতেই আমি সুনামির এক বছর পর-এর একটা কবিতায় লিখেছিলাম


খাঁড়ির ভেতরে নেমে দুই তাত্ত্বিক

আজ অভ্র তামা এসব খুঁজে পায়নি

আমরা যারপরনাই      তবু তাদের লক্ষ্য করে গান গাই

সত্য বই

তোমাকে নিজের কথা মিথ্যে বলিনি।

                                                (অর্থাৎ বই)
   

সত্য বই এই শব্দদ্বয় বাহারী নয়, কথার কায়দা, গোপন ছন্দের সুড়সুড়ি কিছু ছিলো না। একেবারে বাস্তবিক ব্যাপার ছিলো। ওই সময়কার যে নোটবই ছিলো যেখানে experiential interpretive দুরকমের ভাবনাই সাপ্তাহিক লিখে রাখছিলাম, একটা ৩ইঞ্চি বাই ৪ ইঞ্চি খাতা তার নাম দিয়েছিলাম সত্য বই। কেননা তাতে কেবল সত্য লেখা হতো।



শান্তনুর কথার খেই ধরে বলি যে ভূতাত্ত্বিকের এবং কবিরও যে একটা field work এর ব্যাপার আছে,  তা কিন্তু ওই নৃকুলবিদ বা নৃতাত্ত্বিকের মতোই। তফাৎ এই যে ভূতাত্ত্বিকের টুলগুলো সবই বিজ্ঞানের,  নৃকুলবিদ ও কবির অনেকরকমের, তাই প্যাটের ভাবনার সমমর্মে বলছি এই কবি ও নৃকুলবিদ এক হয়ে গেলে ভালো হয় না?

5 comments:

  1. প্রেরণাসূত্র - ভাবনাসূত্র - সহলিপি এই নিয়ে আরো একটু খোলসা করে আলোচনা হোক - কারণ নীলাদ্রী যেটা বলেছে, "সহলিপি প্রেরণাসূত্র নয়। ... এক সিরিজ কবিতার আর একটা কবিতা নয়। সহলিপি একটা কবিতা বা শিল্পবস্তুর প্রভাবে লেখা আরেকটা রচনা নয়।" এটা পুরোপুরি সত্যি হলে তা হলে গান থেকেও তো আমরা সহলিপি ব্যবহার করতে পারব না! কারণ গান শোনার পর আমরা পরে কবিতা লেখার ব্যাপারটা যে ভাবেই ব্যখ্যা করি না কেন, তার মূলে ছিল কিন্তু 'অনুপ্রেরণ'। আমার মতে কোন কিছু থেকে অনুপ্রেরণ পেলে তবেই তো সেটাকে আমরা সহলিপি নেবার কথা ভাবব!

    তার থেকে বরং আমার আর্যনীলদার ব্যাখ্যার সাথে কাছাকাছি অনুভব করছি এই সূত্র যে তিনি 'নোট' থাকার উপর জোর দিয়েছেন - মানে একটা 'ফিজিক্যাল' নোট থাকা জরুরী। গান শোনা, কবিতা পড়া, সিনেমা দেখা এই সব হোক অনুপ্রেরণা - আর তার পর আমাদের কবিতা গড়ে ওঠার পথটা হোক 'সহলিপি', নোট সহযোগে - আমি এই ভাবে ভাবছি আপাতত

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. সহলিপি বিষয়ে লেখার আমন্ত্রণের সাথে একটা pdf পাঠিয়েছিলাম। সেটা কিন্তু ভালোভাবে পড়ে দেখতে হবে। নাহলে আলোচনা শুরুর জায়গাতেই গোলমাল বাঁধার সম্ভাবনা। নীলাব্জ আমার সেই লেখা ত্থেকেই উদ্ধৃতি দিয়েছে।

    সহলিপি ও প্রেরণাসূত্রকে কখনোই মিশিয়ে ফেলা উচিত না। না হলে, দুদিন পর একজন জানলায় দাঁড়িয়ে দৃশ্য-দেখে-লেখা কবি এসে বলবেন ওই জানলার ফ্রেমে যেটা দেখলাম সেটাই তো সহলিপি – এতো চিরকালই আছে, সব কবিই ব্যবহার করেন একে – এ আর আশ্চর্য কি! আরো একজন এসে হয়তো আরো একধাপ এগিয়ে বলবেন – আমার সহলিপি আমার মনের ভেতরে লেখা আছে। তার থেকেই তো কবিতা জন্মাচ্ছে। ক্রমশ, truckloads of such vagueries will be born ।

    যেটা অনুপ্রেরক, লেখার পেছনের শক্তি, তাকে অনুপ্রেরক, source text ইত্যাদি বলা যাক। সহলিপিকে আলাদা হতে হবে। সে এক প্রস্তুতিলিপি, নয় সমান্তরাল রচনা, নয় উত্তরলিপি। এইভাবে সহলিপির একটা শ্রেনীবিন্যাস করতে চাইছি – prepText, paraText, postText। prepText এক ধরনের preparatory text। paraText - সমান্তরাল লিপি যার কিছুটা সরাসরি মূল কবিতায় ব্যবহৃত হচ্ছে, বা এক লেখা থেকে সম্পূর্ণ অন্য লেখা হয়ে যাচ্ছে; আর উত্তরলিপি অন্য কোনো এক লিপিকে সম্পূর্ণ রেফার করে, আলোচনাভিত্তিক এক কবিতা।
    যে প্রশ্নটা এখানে উঠেছে – যে কাগজের মাধ্যম যার নয়, অর্থাৎ চিত্র (পর্দা) বা সঙ্গীত (বাদ্যযন্ত্র বা বাজানোর যন্ত্র) – সেগুলো কি সহলিপি হতে পারছে? যে ছবিটাকে আমি লেখার মধ্যে অনুস্থাপিত করছি সে কি সহলিপি? যে গানের বেশ কিছু লাইন আমি কবিতার মধ্যে install করলাম, বা যে গানের সুরাশ্রয়ী কবিতা লিখলাম সে গান কি সহলিপি। এ প্রশ্নটাকে খোলা রেখে সবাইকেই কিছু বলতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

    নিজের বক্তব্য ও ভাবনা পরে সাজাবো।

    ReplyDelete
  4. এম্বেডেড ছবি/সুর ইত্যাদি তো অনেককাল ধরেই হচ্ছে। আজ সেগুলোকে সহলিপি বলাটা ঠিক কিনা সে প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু 'দূরান্তের হেঁশেল' - গোটা লেখাগুলো যদি কবিতাকে উস্কে দিতে পারে, বা কবিতার উস্কানি খেয়ে উত্তরলিপি হিসেবে লেখা হয়, তাহলে উদাহরণ হিসেবে আলোচনার মতো।

    ReplyDelete
  5. পরের ভাবনা এই যে তাহলে দেখা যাচ্ছে সহলিপি সবসময় 'unseen' নয়। প্রাক-লিপি ও সমলিপি হিসেবে তার সবটা কি অনেকটাই 'অদৃশ্য'। পাঠক দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু যখন সে উত্তরলিপি তখন সহলিপিটাই মূল কবিতা/লেখা। সব্যসাচী 'এপ্রিলতার' সময় এটা বলেছিলো। এই সহলিপির কথা। 'এপ্রিলতা' খানিকটা ভ্রামণিক দিনলিপি ও 'মুখার্জি কুসুম'এর পাঠ-প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুরু হয়। সুতরাং তাকে পোস্ট-টেক্সট বা উত্তরলিপি ধাঁচের সহলিপি হিসেবে ধরা যায়। যেখানে সহলিপিটাই মূললিপি বা মূল কবিতা। কিন্তু এখানে একটা জিনিস পরিস্কার রাখতে হবে। 'সহলিপি'র যে টাইপটা উত্তরলিপি, সেটা যেন মূললিপিকে সরাসরি 'রেফার' করে। যেটা বিষ্ণু দে-র কবিতায় হয়েছে - আমার পরের পোস্ট। একটা ডাইরেক্ট রেফারেন্সিং জরুরী। তা নাহলে ধারণা হিসেবে তা দাঁড়াবে না। অনুপ্রেরণা তো সবসময়েই আছে। সেটা গ্যাসের মতো যা বেলুনটাকে ওড়ায়। কিন্তু একটা বেলুনকে তার থেকে আলাদা করতে গেলে তার মাপ, তার রঙ, তার গায়ের নকশা, তার উড়ন্ত-জীবনের আয়ু - ইত্যাদি আসবে।

    ReplyDelete