Sunday, November 6, 2011

ব্লেডলিখিত সত্তাচিহ্ন

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়


১৭

নিশপিশ করে ওঠে বন্ধুত্ব ভাঙা কাচ
স্তব্ধ মিনারের দিকে সহজ ঔজ্জ্বল্য
আমরা ভেদ করতে পারিনা
অনচ্ছ হলুদ আভা ছন্দ ঠিকরে
ধেবড়ে গেছে ভাষার দেয়ালে –
অথচ কত সহজে লিখে ফেলা যেত
কেমিস্ট্রি বইয়ের ফাঁকে লাল পাতা
শুকনো ঝরা ব্লেড
সম্ভাবনাময় শিরা
আমিতো এড়িয়ে গেছি, বলো,
কতদিন তোমাদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে বসে
বারান্দায় পরিব্যাপ্ত কফি
মাথা নামিয়ে বসে থাকা পার্কে কোথায় যায়?
এইসব সরু লাইন নিভৃত কুকুর হয়ে
নীলিমা ঔদাস্যে কাকে চায়?
এই দীর্ঘ দুপুর, ভিজে বালিতে গা ডুবিয়ে থাকা?

১৮


অথচ যেটা চেয়েছি সেটা পাথরের উপরে
ধাপ ভেঙে উঠে গেলে
শ্যাওলা ও জল ভাঙা নৈঃশব্দ্যে
পৃথিবীর স্পর্শের বাইরে
তবু আমাদের হাতে একটা বই
এই জায়গাটার কোনও ইতিহাস নেই গাছ ছাড়া
পুরনো বলতে কোনও দিগ্বিজয়ী রাজা
বা তার পুরনো সংগ্রহশালার সামনে বসে
শিহরন? অবশিষ্ট নেই
চোখেমুখে জল ঝাপটা
কুয়াশার ব্লেডরংবিলাসী জল

২০

অথচ লেখাগুলোর নরম হওয়ার কথা ছিলনা
এই সময়ের রোদ সে তো টানটান প্রতিশ্রুতি
– ছাদে লেপ উত্তাপে দিচ্ছে মা –
ডিসেম্বর তো জড়ানো থাকে মজ্জার স্টিলে
অনুতরঙ্গের সবুজ সময় উচ্ছ্বাসে
তারপর কী? মরুটিলার ওপর
আক্রমণ করে বেঁটে স্পোর্টসকারের ঝাঁক?
কাঁকড়া বিছে ডুবে যায় বালিতে?
বালি তো শরীর, জেদি লাল পাথর কতদিন
জাগিয়ে রাখে প্রতিরোধ?
পাখির শিকারি ঠোঁট থেকে ঠিকরে পড়ে মাংস
থ্যাঁতলানো লেখা, ম্লান রক্তিম

মুখ ঘুরিয়ে নেবে বলো, ঠিক যেভাবে
বৃদ্ধ মানুষের বিকেলের পার্কে বসে থাকা?


২১

দৌড়চ্ছি ইঁটের গলি
লাল গতিহীন প্রস্তরতা একটু পরে মিশে যাবে
স্থির বৃষ্টি থেমে থাকা পানা থকথক পুকুর
হাত ডুবিয়ে লেগে গেছে সবুজ চূর্ণ অথচ
কলেজ যাওয়া আটকে নেই
পূর্ণিমার আঁশ ও একটু শহরে গিটার নিয়ে
প্রতিভাবান মঞ্চে আলোকিত
আমরা অকস্মাত ঢুকে গেছি সেদিন চৈত্রমাস
দূরে তেপান্তর গানটাই কি নচিকেতা?
ফিরে এলে মিথ্যা ও অসীমের মাঝে আর্তনাদের
রেশের মত জেগে আছে পাড়াটা
তখনও কাঁপছে চামড়া, নির্গত শব্দগুচ্ছ
ফিরবেনা জেনে নির্মিত হয়েছে
একটা পার্ক, কেন্দ্রে






২২

এভাবে নিজেদের কী ফিসফিস করি?
শাসকদল নিস্পৃহ মৃতদেহ ফেলে গেলে
শহুরে বন্ধুরা বিশ্বাস করেনা?
জমাট হাওয়ার পাশে শীতল তো আমি চাইনি
শুধু হাড় আঙুলে নিজস্ব বাঁক নিলে
হাত নিজে থেকে কিছু আঁকড়াতে চায়...
সামনে প্রস্তর নির্মাণে একটানা ক্ষয়

বুকের ভিতরে শুকনো রাস্তা আঁচড়ে
কুকুরদিন কী পায়?






২৩

সেই প্রস্তরতা খুঁজি এখন কোথাও
শীতের গায়ে জমাট পালকের স্তূপ হয়ে আছে
দূরের শহর... হয়ত শব্দটাকেই প্রিয় ঋতু মনে হয়
প্রিয়তা কোথায় যায়? এখন এই অক্টোবরে
ভেসে যাওয়া দেশে পুরনো গান শুনে
কেই বা রোদ্দুর?



২৪

তবুও সেইসব রাস্তাগুলো সহজে ভেঙে দিতে পারোনা
পাশ কাটানো নোংরায় দাঁড়াতে বলিনা, সামঞ্জস্যপূর্ণ,
যখনকার যেমন, পার্কে পেশাদার মালির মধ্যেই তো ছায়া!
ঢুকে যাও, প্যাকেটের মশলা কৌটয় স্বাভাবিক।
এইসব আয়নায় পারদ ওঠেনা
কেউ কি বলল?
অথচ পাথর ছিল
সমুদ্রের নুন লেগে পিছল মাতৃভাষা
একবারই মুখ থুবড়ে রক্ত শ্যাওলা মাখামাখি
উঠে এসেছিলে ঘরে, পতনকালে কি
আঁকড়ানো পাথরটা ছেড়ে দিতে পারতে?
শিথিলতা ঘষটে সহজেই এসে যেত
শ্রুতি-দর্শ-স্পর্শহীনতা
কে ছিল তখন?
আঁচড় ছাড়া রাতই কি প্রস্তরতা?
ঠিক কি কারণে ফিরেছিলে?
এই বালি ধর্ম ব্লেডের ওপরে
অতিদ্রুত চলে যাওয়া শোণিত ধারালো সাপ
কেন চেনোনা?

8 comments:

  1. রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়November 7, 2011 at 9:34 AM

    সার্থক নামকরণ - ব্লেডলিখিত সত্ত্বাচিহ্ন
    ব্লেড দিয়ে লেখা যায় না, কিছু সত্ত্বাকে চিহ্নিত করা যায় মাত্র। আর তারা যখন আমাদের ঘিরে থাকা চিহ্নতে হাত লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, ভাবি এ কার কথা? তোমার না আমার? এ কার ব্যথা ব্লেড দিয়ে চিহ্নিত করো? তোমার না আমার?

    বহুদিন পর শুভ্র তোমার লেখা পড়লাম এবং মুগ্ধতা নিয়ে গেলাম একরাশ

    ReplyDelete
  2. আমি বেদনার ভিতরে নতুজানু...

    তোমার কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম রুণাদি।

    ReplyDelete
  3. শুভ্র
    রুণার কাছে ওর মুগ্ধতার কথা শুনে তোর এই কবিতাগুলো পড়লাম।
    ধারালো সাপটা আমার শোণিতে খুব ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে রে...সেই ব্লেডের মতো যার কোনো মাত্রা নেই অথচ ফালা ফালা করে দিচ্ছে..
    অসামান্য!

    সুদেষ্ণাদি

    ReplyDelete
  4. আবারো কৃতজ্ঞতা...

    ReplyDelete
  5. "hayto sabdaTaakei priya writu mane hay..."
    asaadhaaraN!anek fele aasaa raastaa, priya uchchharaN, priya naishabdya mane parhe jaay...uff..
    avinandan jaanaai shubhro.

    --- Nilabja

    ReplyDelete
  6. পরে আরো লিখবো। একটা কথা অনেকদিন ধরে বলতে চাইছিলাম। ৯০% কবিরা আমাদের ৫ ইন্দ্রিয়ের মূলত একটার ওপর নির্ভর করে কবিতা লেখে - চোখ, দেখা। অথচ ঘ্রাণ আছে, স্বাদ আছে, কান আছে, স্পর্শ আছে - এই অনুভূতির ওপর নির্ভরতা কমে আসে। শুভ্রর কবিতায় স্পর্শেন্দ্রিয়ের প্রখর ব্যবহার থাকে। সে (হয়তো নিজে নরম বলেই) "নরম" শব্দটা বারবার ব্যবহার করে। ব্লেড স্পর্শের দিকে ইঙ্গিত করে। আরো অন্যান্য স্পর্শজাত অভিব্যক্তি কবিতাকে গ্রাস করে। সমুদ্রের নুন লেগে তার মাতৃভাষা পিছল হয়। এই দিকটা লক্ষনীয়। ধ্বনিও জমাট হয়। অন্ত্বসত্তা হয়। তাই ওর শব্দটাকেই ঋতু মনে হয়।

    বহু জ্ঞানশাখায় কবিতাকে আমরা যেভাবে ঘাড় ধরে নিয়ে যাই, যেখানে গায়ের জোর প্রকাশ পায়, শুভ্র সেই মাল্টি-এপিস্টেমোলজিকাল চেতনায় কবিতাকে ভুলিয়ে নিয়ে যায়। কবিতা ভুলে যায় সে যমুনায় ছল করে জল আনতে এসেছে। এই মেয়ে-পটানোটা সে আমাদের চেয়ে ভালো বোঝে। সেই জন্যেই হয়তো কবিতার গা থেকে সব অলঙ্কার খুলে নেবার দায়ে আজ সে আলিপুর জেলে। সেই জেলেকে আরো জাল সাপ্লাই করাই আমাদের একমাত্র অভিপ্রায় হোক।

    ReplyDelete
  7. এবার আমার বেশ লজ্জাই করছে!

    তবে স্পর্শের প্রাবল্যের ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত। চিতাবাঘ শহর থেকেই এই জিনিসটা আমার ভিতরে কাজ করে গেছে। তখন ছবি দিয়ে স্পর্শকে ধরতে চাইতাম। এখন সে জায়গা নিয়েছে সিনেমা।

    ReplyDelete
  8. যে লিরিকি লেখাকে নষ্ট করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এই ব্লেডলিখিত রচনার প্রত্যয়, তারই এক মনোরম উদাহরণ দেওয়া হলো ১৭ নম্বর অংশে। ১৮ নম্বর অংশ থেকে বদলে যাবার কারণ যেমন দর্শানো হচ্ছে তেমনি ভাষার ব্যবহারকেও বদলানো হচ্ছে। ম্যাকাবার বা শ্বাপদ মাথা চাড়া দেয় ২০ নম্বরে।

    কিন্তু সাবধানবাণী। লেখা কিন্তু যতোই অঙ্গীকার করুক, যতোই বলুক সে "নরম" [স্পর্শ] হতে চায় না, প্রায়শই সে মধুর হয়ে উঠছে। কোনো কোনো অংশে তাকে অত্যন্ত ধারালো ও রক্তাক্ত দেখতে চাই।

    পার্ক মাঝে মাঝে আসে। "কেন্দ্র"মণি হয়ে। এই পার্ক হয়তো এক ওয়েসিস - মরুদ্যান। কিন্তু তার জন্য যে দারুণ একটা খোঁজ চলে এমনও না। রূপককে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ সময়ে চট করে ধরা যায়না কে কার রূপক। পরিবিষয়ীতে যে "অরূপক"-এর কথা বলা হয়েছে, সেরকমই। আর বড় আকারের যেসমস্ত রূপক - যেমন "পার্ক" "নুন" "পাথর" বা "প্রস্তর", "ব্লেড" ইত্যাদি - তার ব্যবহার বাংলা কবিতার প্রথাগত ধারার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

    কেন ব্লেড-লিখিত সত্ত্বা ? এইটা আমাকে এখনো ভাবাচ্চে এবং এইটা খুব ভালো দিক। রুণার মন্তব্য দারুণ। এইটা আমার মনে হয়নি। এর থেকেই প্রমাণ হয় যে "ব্লেড" এর ব্যবহারের মধ্যে নানা স্পেস রয়েছে। সে পরিশীলিত অতি-স্পষ্ট রূপক নয়। ডাইড্যাক্টিক নয়। বরং ইনফারেনশিয়াল ও পরিবর্তনশীল।

    ReplyDelete