প্রিয়
সম্পাদক,
আমি খা-খা আলোর মধ্যে বসে
ভাবছি ভোর হল কী-না! শূন্যতার মধ্যে মোহর মোহর শব্দে ঝরে যাচ্ছে ফুল—আমি
জিরিয়ে নিচ্ছি নিষ্ক্রিয়তায় পিঠ রেখে—একটা খুব যতি
হল মনের মাঝারে আমি ঠিক সেখানেই ধ্বনি ও অর্থের মাঝে বিষক্রিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে
সেরে উঠছি আর নেমে যাচ্ছি জ্বরের ভেতরে। প্রিয় সম্পাদক, আমি ঠিক জানি না কতদিন
কবিতা লিখিনি, কবিতার আড়-মধ্য দিয়ে কতখানি মরচে রাঙ্গানো পথে আজ ভেরেন্ডার জঙ্গল,
কাঁটানটে, পা ছড়ে যায় আর অব্যক্ত হয়ে ওঠে স্মৃতি ও করুণা—রাঙ্গামাটি
বলতে এটুকুই বুঝেছি সম্প্রতি...গ্রন্থি
দিয়ে স্নায়ু দিয়ে মায়েলিন শীথ ভেদ করে ভারী ও অবশ সীসার নদী বয়ে যায়-- এ’টুকুই ভ্রমণ আমার। ফলে সম্পাদক, আমি জানতে চাইছি আপনার পত্রিকায় না ছাপার জন্য ঠিক কোন ঠিকানায় আমি আমাকে
পাঠাব।
---------
প্রিয়
সম্পাদক,
আমি খুব খুঁজতে চাইছি বৈরিতা।
সযত্নে নামিয়ে আনছি মগজ লিভার কিডনি ফর্মালিন থেকে ধাপে ধাপে চলে যাচ্ছি তীব্রতর কোহলের গ্রেডে—গলে
যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে স্নেহ—আমি সমস্ত স্নেহাতীত টিস্যুর
টুকরো থেকে মাইক্রোটোমের থেকে সেকশান নামিয়ে আনছি কাচের স্লাইডে স্টেনে ডিস্টেনে—আমি
বৈরিতা নিয়ে ভাবতে ভাবতে 63X অবজেক্টিভে ভাবতে ভাবতে দেখছি
মানুষের কতবিধ সমস্যা অথচ একএকটা সমস্যার
জন্য পর্যাপ্ত মানুষের কীরম অভাব...
--------
প্রিয় সম্পাদক,
বানানের
শুদ্ধতা নিয়ে বুঝতে পারছি আপনার অনুযোগ,
এদিকে মোমবাতির তলায় ঘাম, ৪৫ ডিগ্রি, জানেন ৪২-ডিগ্রিতে কম্পিটেন্ট ব্যাক্টিরিয়ার মধ্যে হিট শকে ফরেন ডি এন এ
ঢুকিয়ে দেয়া যায় আর সে তারপর অপারগ নিজের প্রায়োরিটি ফেলে দিয়ে উৎপাদন করে সোনা—আমি সোনায় দাঁত বসিয়ে মেপে দেখছি শুদ্ধতা—আকাশ থেকে ভাগ্যের ছায়া পড়ছে মাটিতে, আকাশ থেকে কুচি কুচি অভাব ভেসে
বেড়াচ্ছে—আমি শুদ্ধতার স্বাদহীনতার ভেতর থেকে
দেখতে পাচ্ছি ফিলামেন্টের অ্যালয়ে মাছি বসছে আর আলোয় কাঁটা হয়ে উঠছে শালবন। ক্ষমা
করবেন শেষ কটি লাইন জটিল হয়ে গেল।
প্রিয়
সম্পাদক, আমি জানি
আপনি জটিলতা পছন্দ করেন না। ট্যাক্স রিটার্ন-এ যতটুকু জটিলতার প্রয়োজন, হিসেবের বাইরে থাকতে যতটুকু দরকার, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে
যৎসামান্য যতটুকু, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যতটুকু, রাতের দিকে ঘোড়ার ছপটি হাতে আপনার চোখ উরুসন্ধির দিকে চকচক করে, লালা গড়ায়—প্রাইমাল জটিলতা—এই সব এইটুকু ছাড়া—কবিতা তো সোজা সাপ্টা মানুষের কথা প্রকৃতির কথা হওয়া
উচিত—জেনারেশান গ্যাপ, ছেলের সাথে বনিবনা নেই, বৌ কে বোঝা মুস্কিল, নিজেকেও এমনকি নিজের আর্জ,
ইম্পালস সময়ে সময়ে অবোধ্য লাগে—এত ইংরেজি শব্দের কী প্রয়োজন…আই এগ্রি,
আমি সহমত, প্রচন্ড সহমত আজ মোতিয়া বেলির গন্ধে
কী ভাবে জানি না,নাকের বদলে চোখে জল এল… কোথাও শিশুবেলার বাগান থেকে…আমি ফিরে তার জটিলতা দেখি, সারল্যের সাথে একসাথে বসে সেও
পুতুল খেলছে...
------
প্রিয়
সম্পাদক,
“আমাকে বুঝতে গেলে জটিলতা অর্জন কর। সারল্য
তোমাকে সারাতে পারত, সেই সব দিন চলে গেছে”—এভাবে
বলতে পারতাম, গানের
লাইন হিসেবেও মন্দ নয়—তবে বিনয়ে বাধে। বরং এ’ভাবে বলি, আমার কবিতার একমাত্র কাজ আমার
একাকীত্বকে সন্দেহ করা। আত্মপক্ষের বাঁট ঘুরিয়ে দিয়ে অন্ত্রে ঢুকিয়ে দেওয়া ফলা।
রেটরিক বলতে প্লেটোর কথা মনে পড়ার ছিল অথচ আমি ট্রটস্কির কথা ভাবছিলাম এমন কী বুড়ো
শরীরে হঠাত গজিয়ে ওঠা অটোইমিউনিটির কথা। আসলে ইতিহাস থেকে, প্রতিরোধ
ক্ষমতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা মগ্নতার কথা ভাবতে পারি না। প্রদাহ ও শীতলতার
মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া রেখা আমাকে আশ্চর্য্য করে— আমি হতবাক দেখি তার আপাত সারল্য অথচ তার কোষ ও কণার
কী চূড়ান্ত জটিল ভারসাম্য...
---------
প্রিয় সম্পাদক,
এই
১১টা ৩২-শে এসে আমি কবিতা লিখছি না। গাড়ির মধ্যে হাওয়া বইছে। মাড়ির মধ্যে বিশদ করে
হাওয়া বইছে। আমি পাতে ফলের হাড় আর কানকো ফেলে উঠে পড়ছি পরমুখী বাতাসে। কথা হচ্ছিল
মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে। শবরদিনের শেষে ছন্দের বদলে সলিউবল তন্তু নিয়ে আরো
মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন ছিল। অথচ তন্তু বলতে শুধু কোমরের কথাই ঘুরে ফিরে আসে—সমস্ত মাত্রায়। আমি ডুবতে ডুবতে ডুবন্ত মানুষের
ধর্মের কথা ভাবি, তার
জিরে, মৌরির কথা, বুকের ভেতর বেড়াতে বেড়াতে
রান্নাঘরের দিকে আসার কথা—আর আঁশের স্মৃতিতে চকচক করে ওঠে জল।
ডুবতে ডুবতেও এক ফালি তৃষ্ণার কথা মনে পড়ে। এই হাওয়ার সময়েও খুব মনে পড়ে।
---------
প্রিয়
সম্পাদক,
আমি ধৈর্যের মধ্যে বসে আছি,
আপনার বিলম্বের মধ্যে—বাগান থেকে
ফর্ম ডাকছে, আস্তাবল থেকে ঘন ঘন ডেকে উঠছে মোরগ, এথিক্স...। আমরা যা ফেলে যাচ্ছি
সেটাই পৃথিবী-- এও আমাকে স্টাইরোফোমের কাপ থেকে বলে গেল। ঘোলাটে নোশানের মাঝে আমার
ভালো লাগছে আপনার বিলম্ব, ভালো লাগছে আপনার পছন্দ, বাছাইপ্রক্রিয়া—আমি
জানি ইচ্ছের থেকেও বড় শক্তি রয়েছে কোথাও – যে
আপনাকে পাহাড়ের কাছে নিয়ে যায়, সমুদ্রের কাছে, স্তেপে, সাভানায়, বেডরুমে। আমি
অ্যাপ্রিসিয়েট করতে বাধ্য হচ্ছি গতি—সমুদ্রের
মধ্যে ডিসম্যান্টল হয়ে যাওয়া পেচ্ছাপের ফেনা, উপহার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়া মোড়ক
আর শুভেচ্ছা। অথচ আমার ভালো লাগছে এই ধৈর্যের মধ্যে বসে থাকা। আপনার বিলম্বের
মধ্যে ঠায় বসে থাকা...
--------
প্রিয়
সম্পাদক,
প্রবল গ্রীষ্মের মধ্যে শীতের
প্রসঙ্গ, বসন্তের কথা এতটুকুই আমাদের, সুখী মানুষেরা বিচ্ছেদের কথা বলে, আলো
নিভিয়ে হিজর-এর গান শোনে অন্ধকারের ভেতরে বাদলা পোকা ওড়ে অন্তহীন—আমি
এতদিনে জেনে গেছি কমপ্লিকেশান-ই একমাত্র বাস্তব, বাকীটুকু ভাতঘুমের মত জৈবিক—যা
বস্তুর চেতন থেকে অজানিতেই দূরে ঢলে পড়ে। প্রিয় সম্পাদক, বাস্তবের বাইরে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে বুক
ওঠে, নামে আমি তার সাথে অবিচ্ছেদ্য জুড়ে আছি—ফলে এই
রিদম থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজের হাতের থেকে সরে এসে পেথিডিনের সিরিঞ্জ নিয়ে খেলা করা
ঘোলাটে বেড়ালের দিকে চটিও ছুঁড়তে পারি না...
-----
প্রিয়
সম্পাদক,
আমি বেড়াতে এসেছি, আপনার ও
আমার অবস্থানগত পার্থক্যের মধ্যে বেড়াতে এসেছি—এখানে
কুড়িয়ে পাচ্ছি রজঃস্বলা ঝিনুকের সারি, মুক্তোর ক্রিস্টালিনিটি থেকে দূরে, আরো
দূরে। প্রিয় সম্পাদক, মানুষের ইতিহাস বলে সভ্যতার পূর্বে সে তার গুহাবাসি আঙুল
তুলে এনেছিল একাধিক ঊরুসন্ধি থেকে আর গুহার দেয়ালে নানা রসের স্থিরচিত্র এঁকেছিল
যা ব্ল্যাকলাইটেই কেবল দৃশ্যমানতা পায়—সে শবর ছিল,
জুগাড়ু ছিল—এক চড়ুইভাতির দিনে বন্ধ হল্ট
স্টেশানে এসে সে মদের হাঁড়ির খোঁজ পেল—আর নেশার জোগাড়ের
জন্য কৃষিকাজের কথা ভেবে উঠল। এর পর সম্পত্তির কথা আসে, উত্তরাধিকারের কথা—এই
সূত্রে তার বৃন্দযৌনতার থেকে সরে আসা। আমি যে আমার উত্তরাধিকারের জন্যে মানুষের মন
থেকে সমাজ থেকে সরে আসব—এও তো
স্বাভাবিক, আর যা স্বাভাবিক তাকে নিয়ে আর যাই হোক যুক্তিগ্রাহ্যতার কথা বলবেন না,
প্লীজ। প্রিয় সম্পাদক, আমাদের অবস্থানগত পার্থক্যের মধ্যে বেড়াতে বেড়াতে আমি কাচের
ওপারে দেখতে পাচ্ছি মানুষের স্বভাব কাঁচা পেঁপের মত সবুজ—নক্ষত্রের
জন্য উদ্দিষ্ট তাদের গানগুলি একের ওপর এক জমে উঠছে—গণনার
জন্য অপেক্ষা করা টাকার বান্ডিলের মত...
--------
প্রিয়
সম্পাদক,
চোখ নামিয়ে আনতে হবে, তবেই
দেখতে পাবেন—আমি ধাতুর মত অর্জন করছি ক্ষয়,
ধাতুর মত ব্যর্থ হয়ে উঠছি—নুনজলের জগতে
অসাড় আলোর মধ্যে আধাপ্রবেশ্য পাতলা পর্দা মাত্র হয়ে গেছি। আজ চারিদিকে ছুটি ন্যস্ত
হয়েছে—ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছে বেড়াল ও গাড়ির
সেলসম্যান—তারা এক পৃথিবীকে দেখছে, যে
রঙের আড়ালে ফাটা ঠোঁটের যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখছে। নাহ, আমাকে ভুল বুঝবেন না আমি
গুণগত অবস্তুসকলে আজ আরোপ করতে চাইছিনা স্পষ্টতা...ইন ফ্যাক্ট স্পষ্টতা আমাকেও
সরিয়ে রেখেছে কবিতার থেকে। কানের মধ্যে আজ কেউ সন্দেহ ঢেলে দিয়ে গেল সেই থেকে
ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছি পতনভীতির মধ্যে আপনাকেও হারিয়ে ফেলছি। ভালো আছি প্রিয়
সম্পাদক, পাতলা পর্দা হয়ে, দ্রাবকের চলাটুকু নিয়ে ভালো আছি,
ব্যক্তিসত্ত্বা না হয়েই ভালো আছি।
------
প্রিয়
সম্পাদক,
ফর্ম বলতে এক বিকৃত আয়নার কথা মনে
পড়ে—যার মধ্যে দাঁত ঠোঁটের গভীরে ধ্বসে গেছে
আর জিভের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে কালো প্রবাহ। ফর্ম বলতে এক গানের সুর মনে পড়ে যার একাংশ
হয়ে আছে গত পাঁচ সাতটা বছর। ফর্ম বলতে সংক্ষিপ্ত মনে পড়ে রাত্রির কথা সাবলীলতার
কথা মনে পড়ে আর গাছের, পাথরের কথা তাদের গোঙ্গানির
শব্দ নিয়ে বেড়ে ওঠার কথা। ইঁট কাঠের কথাও মনে পড়ে, রাত্রের সৈকতে বুনো কুকুরের
ভীড়ে হারিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে...
------
প্রিয়
সম্পাদক,
আচমকা শেষ হয়ে যাওয়া রেখা, তট এই সব আমার প্রক্রিয়া—জানেনই তো
আয়ু থেকে সময় বার করে লিখতে হয়—প্রজ্ঞা মাত্রেই কাউন্টার
প্রোডাক্টিভ এটা বোঝার জন্য প্রজ্ঞা অর্জন করার প্রয়োজন হয় না—যখন
সর্বনাম সমেত পিঠ ঠেকে যায় দেয়ালে—তখন মেঘ কাটে, মানুষ দেখতে পায় রেসভেরাট্রল নিয়ে ৯০% গবেষণা স্পন্সর করছে
ক্যালিফোর্ণিয়ার ওয়াইন ইন্ডাস্ট্রি। বাই দ্য ওয়ে দেশী সূলা যথেষ্ঠ ভাল কাবার্নে
বানায়—তথাপি আমি কারাকাসের মত খোয়া ওঠা রাস্তার গন্ধ, বৃষ্টিতে পীচফল মেশানো গন্ধের ওয়াইন অন্যত্র খাইনি কখনো—অবশ্য
পাসপোর্ট খুলে ভেনিজুয়েলা’র অভিজ্ঞান দেখাতে পারব না—বলে
রাখা ভাল ক্যালিফোর্ণিয়ার কার্লো রোসি ওয়াইনে আমি কেবল কেরুয়াক,হোবো আর অড্রি হেপবার্নের ফ্লেবার
পেয়েছি—থাক সে প্রসঙ্গ, বরং সর্বনামের কথা কেন এল সে নিয়ে বলি— বলি, আমার প্রতিফলন ওয়াইন খেতে ভালোবাসে, আর আমি ওয়াইন খাই না— অ্যাসিডিটি হয়। আয়নায়, বিছানায়, বাথরুমে, রান্নাঘরে
নৈমিত্তিক অম্লস্বাদের মধ্যে হাটুরে ক্লান্তি নিয়ে জেগে ওঠা--দৃশ্য থেকে বাইশগজ
দূরে হেলমেট ছাড়া, অ্যাবডোমেন গার্ড ছাড়া… এই আমার কবিতার ইম্পেটাসটুকু —আর
এও যে কাউন্টার প্রোডাকটিভ সে নিয়ে আপনার অ্যাটলিস্ট সন্দেহ থাকার কথা নয়…
------
প্রিয়
সম্পাদক,
ফ্ল্যাটবাড়ির জানলা থেকে দেখতে
পাচ্ছি—কালো পাতার ফাঁক দিয়ে মূর্ত হয়েছে রাস্তা, ট্রাফিক, বৃষ্টি। ব্যালকনিতে দুজন অ্যাডাল্ট কথা
বলছে ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে, যোগাযোগের ফাঁকফোকর নিয়ে—কেতাবী
সিন্ট্যাক্স ক্রমশ ডিসজয়েন্টেড হয়ে উঠছে—ঘোরাফেরা
করছে আশার মধ্যে হিস্টিরিয়ার মধ্যে—এই
সান্দ্রতার মধ্যে কখন যে একটা দরদালান আকাশে চারিয়ে গেল বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করবেন
এইখানে ফায়ারপ্লেসের পাশে যদি ভঙ্গুরতার কথা, আবছা হয়ে ওঠার কথা
মনে পড়ে…জানি আপনি বলবেন মীথের ভিতরে ঢুকে গল্প আর ক্লিশে হয়ে
উঠে কবিতা পরিণতি পায়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, নিষ্পত্তি কাম্য নয়--
কবিতা তো সন্তানের দিকে স্নেহে মুচড়ে ওঠা পুরুষস্তন। ফলে যোগাযোগের কথা, চক্র সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার কথা এই সব নিয়ে ভাবি না সম্প্রতি—বরং
বিষয় থেকে বিষয়ে ছুঁয়ে যাই আঙুল-- যেটুকু চামড়ার গন্ধ উঠে আসে, যেটুকু অসুস্থতা তার্পিন দাহ্যতা নিয়ে ফিল্মরোলের মধ্যে, ধ্বনির মধ্যে, মধু ও ক্ষারের ভেতর ঢুকে যায়…
------
প্রিয়
সম্পাদক,
আম খায়েঁ কী গিঠলি গিনে—এই
সব ছদ্মসংশয়ে আছি। অবশ্য আমি আপাদমস্তক সংসারি লোক—আম
খাব আর আঁটিও গুনবো—এটাই তো স্বাভাবিক। আসলে রঙের থেকে
দূরে আছি একটা আপাতগ্রাহ্যতা থেকে আমি সাদা কালো পৃথিবীর কিসসায় মাখোমাখো মানুষের চেতনার
মাঝখান থেকে নদীটুকু অবলম্বনটুকু চুরি করে ঢুকিয়ে দিতে চাইছি ধূসর বিপর্যয় আর এরই
মধ্যে শীলভদ্র প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিব্বত যাত্রার—ঠিক
এই ভাবে চলে যাব আম খেতে খেতে আঁটি গুনতে গুনতে… আই অ্যাম এ ননএনটিটি, বৃহত্তর পাঠকজগত আমাকে চেনে না—প্লীজ
ডোন্ট আস্ক মী সাচ টাফ কোয়েশ্চেনস—হোয়াটস দ্য ইউজ—মাই
অ্যানসার্স উইল নেভার বি হার্ড এনিওয়ে! নিরন্তর তোমাদের খামারবাড়িতে ধীর নামে
সন্ধ্যার শাঁখ—এই পবিত্রতা আমার সহ্য হয় না—আমি
বরং খুলির মধ্যে লেদ মেশিনের শব্দ রেখে চলে যাব সংসারের ভেতর তার খড়া জিরে ধনে
সর্ষের তেলের ভেতর উপশমের চিহ্নমাত্র না রেখে…লুঙ্গিতে
রিজলোউশনের মহড়া না রেখে…মুছে যাব…
------
প্রিয় সম্পাদক,
আলো তো সঙ্ঘাত
প্রিজমের ক্ষত থেকে
অনিচ্ছা থেকে ঠিকরে ওঠা
ব্যাথা ও উন্মেষ
আলো বলতে আমি দোনোমনার কথা
বুঝি, কখনো এক হলুদ
প্রতিধ্বনির কথাও ভাবি যে ভেড়াদের নৃশংস চৌকো দাঁতের দিকে এগিয়ে দেয় রেটিসেন্ট
নেকড়ের দাবনা। প্রিয় সম্পাদক আলো বলতে আমি দেখতে পাই, পার্কে,
বুলেভারে, ফাঁসে, বুঁদির
রায়তায়, রক্তের মধ্যে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য কনফেশান বুথ— অভ্যাস মত আস্তিন খুলে উন্মুক্ত করি তাস আর
জন্মান্তরের উল্কি—আলো বলতে আমি পাশের গলির থেকে শুনতে পাই
অবিশ্বাস্য জড়তা নিয়ে কে যেন বলছে—হাম কা ছোড় দে গোরি, হামার ধরম লেই যা…
----
প্রিয় সম্পাদক,
প্রতীক ছাড়া আর
কিছু দেখতে পাচ্ছি না এই সময়। মাংসের থেকে বিষয়ের থেকে বেরিয়ে আসছি আর মরচের ছোপ পড়া
কাপড় মেলে দিচ্ছি ছাদে। আমার বসনে জং ধরে, মূর্তিগুলোয় জং ধরে—আমি
বাংলার থেকে দূরে ব্রথেলের মুখ খুঁজে বেড়াই বন্যার দিনে। প্রিয় সম্পাদক, একদিন মানুষ
নিজের স্বাতন্ত্রের তাগিদে নিরাপত্তার তাগিদে খুঁজে নিয়েছিল টোটেম-- কুকুর করে রেখেছিল,
পৈঠার হাঁস করে রেখেছিল—
আজ আমি সার্শির, খড়খড়ির প্রতীকে চোখ রেখে দেখতে
পাচ্ছি—কী অবলীলায় চুল্লি থেকে উঠে আসছে প্রতীক, গ্রন্থ থেকে উঠে আসছে—ওই তার হাত ঝলসে উঠছে… লোমের ভেতর সটান ঢুকে যাচ্ছে,গোঙ্গাতে
গোঙ্গাতে ভয়েরও ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে…
------
প্রিয় সম্পাদক,
দিন পড়ে এল, কথাবার্তাগুলো
পড়ে এল—এবার তো যেতে
হয়—রক্তের ভেতর,
ডি এন এ’র ভেতর হেঁটে
যাওয়া এ’টুকুই পৃথিবীর
যাওয়া। অনির্দেশের মধ্যে অতীতের ছায়া পড়ে জলে। আমি
দেখতে পাই কালেক্টিভ স্মৃতির ভেতর থেকে জলের ভেতর
থেকে উঠে আসা মানুষের শৈশবগুলো শুধু পেকিং অর্ডারের ভেঙ্গে গড়ে ওঠা। প্রিয় সম্পাদক, ইতিহাস নিজেকে রিপিট করছে
কি-না জানা নেই আমার—আমি
শুধু ক্ষতচিহ্ন দেখি—দেখি
হান্টার হাতে সেই সব ক্ষতের ছায়া ও কাহিনী তাড়িয়ে চলেছে আমাদের—আর জলমহিষের মত ভারী ও দ্বিধাহীন আমাদের
পায়ের শব্দ মাটির ওপর, মাংসের ওপর ক্ষত বাড়িয়ে চলেছে…
--------
প্রিয় সম্পাদক,
বধিরতা নিয়ে কামারশালায়
চরিতার্থ হতে ঢুকে পড়া—এতটাই ভ্রমণ আমার। ফিরে আসি
ক্ষতের ভেতরে, পরিখার মাঝমধ্যিখান থেকে দেখি যাপনে কেঁপে উঠছে পৃথিবী—অথচ এও
তো জানি আমার ক্রাইসিসটুকুই আমি, বাদবাকী শুধুই সময়। প্রতি রোববার মাংসের ঝোলে হাত
ডুবিয়ে সংযম খুঁজি, আলুর টুকরো উঠে আসে, পরিখা ভরে যায় কুলগাছে লাক্ষা ক্ষরণে-- এই
আমার বধিরের জন্য লেখা গান, এই আমার নির্মাণটুকু—যা
ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা সময়ের বাইরে বসে শুনতে পায় উপদ্রুত জল থেকে, ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে
উঠে আসা ডাক—ধীবর ধীবর...
------
প্রিয়
সম্পাদক,
ভোর হয়ে এল জলে—ঘরে
রাত্রি রয়েছে ঘুম নেই—দেখছি প্রতিফলন
কীভাবে জলের চেয়ে মানুষের চেয়ে বড় হয়ে যায়। আপনি বলছিলেন ৭৪ বছর পৃথিবীর বয়স
বেড়েছে তিনি চলে যাওয়ার পরে—তবু আমরা
কেউই শেষতর কথাগুলি লিখিনি/বলিনি—আমি সব মেনে
নিয়েও ধ্বস্ত হয়ে আছি, আমার সিন্ধুপারে চাঁদ ডুবিয়াছে, ফুল, পাখি, বেতসের বাঁশি--
সব নিভিয়াছে...আমি ৭৪ বছরের বাড়তি ইতিহাস নিয়ে নিজের মধ্যে বসে আছি...ট্রাকের
চাকার দাগে বসে আছি, ঘাসের ডগায় ঝুলতে ঝুলতে বসে আছি, ক্রিয়ার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে বসে
আছি...ঘোর থেকে সরে আসতে অশুদ্ধতাকেই নাম ধরে ডেকে উঠছি বার বার...
------
প্রিয় সম্পাদক,
“বাস্পের খাঁচার ভিতর তুমি এক বাইশে শ্রাবণ”, অথবা “তোমাকে করি না, তাই তুমি কি করিনা?”—এরকম লিখতে পারতাম কিন্তু লিখতে পারছি না। আমাদের নরম সরম মাটি,
মনোবেদনায় টইটই করে—বেদনার থেকে গড়িয়ে পড়ে স্নেহ—আর স্নেহের নীচে সব থাকে—শ্যাওলা, পাথর,
পোকা মাকড়, মানুষের বিকার—এই চিরন্তনের মধ্যে থ্যাঁতলানো টিকটিকির মত আমায়
থেকে যেতে বলবেন না প্লীজ। আমি তো ভাত খাচ্ছি, ডাল খাচ্ছি, মাঝে সাঝে চুমুটা আঁশটা
যে খাচ্ছি না তাও নয়—তবে নবনীতে নেই—বরং ভুট্টা ক্ষেতে
কশ ছড়ে গেলে বুঝি জিভ এখনো হারায়নি স্পৃহা। ফলে জিভের
কথাই লিখি, দাঁতের কথাই লিখি নরম সরম করে মিডলাইফ ক্রাইসিসের কথা লিখি—যা একমাত্র কবিতা
লিখতে বসলে টের পাই। আমি বিশ্বাস করি, শিল্প কেবল অভ্যাসের বাইরেই গড়ে ওঠে—প্রাকৃতিক উপাদান
নিয়েও সে প্রকৃতির থেকে বিচ্যুত হয়ে বেড়ে ওঠে—ফলে আমি নিজেকে
লিখি না, নিজের স্বভাব থেকে দূরে এক অপরিচিতের কথা লিখি…উদ্ধৃতিচিহ্নের
থেকে ছাড়িয়ে আনি বস্তুর চিৎকারটুকু—তাকে লিখি…
------
প্রিয়
সম্পাদক,
মধ্যাহ্ন
চেগে ওঠে বিরতিশহরে কর্ম কোথাও নেই আমের সিজনে উত্তরদেশের ফলে ছেয়ে গেছে বাজার
বিপণী। আলুবোখারায় দাঁত রেখে বুঝি—বর্জন ভাষাকে সরল আর ভাবনাকে জটিল করে
তোলে। সারল্যের প্রসঙ্গে মনে পড়ল এত পারফিউমের দোকান চারপাশে আমি আর গন্ধ দিয়ে
ফুলকে চেনার কথা ভাবতে পারি না—কাচের জানলার কাছে যদি বিশ্বাসযোগ্য না
হয়ে উঠতে পারে তবে আর ফুল কীসের? বরং লজ্জিত থাকি ফলের পরই ফুলের প্রসঙ্গে আসার কারণে। আমার সমস্ত পতন শুধু
ছায়ার ভেতর, অভ্যাসের ভেতর—ছায়া থেকে,
অভ্যাস থেকে নিজেকে ফেলে দিতে দিতে এ সমস্ত বুঝতে পারি…
------
প্রিয়
সম্পাদক,
কখন
যে ধাতু হয়ে উঠলো বাতাস, জ্যোৎস্নায় ঢুকে গেল পাথরের স্পেসে—সেই খান থেকেই
এ’লেখার শুরু—এ’লেখার শেষটুকু সেখানেই যাবে। এর চেয়ে অলংকার
সোজা, এমনকী
যাদু-বাস্তব নিয়ে, রূপক নিয়ে আমাদের নড়াচড়াও কখন প্রাঞ্জল হয়ে আসে—পংক্তির ছিলা কাঁপে, ভাব কাঁপে—কাঁপুনি সাঙ্গ হলে রিসাইক্লিং-এর দিন ফেরে।
প্রিয় সম্পাদক, আমি
দেখতে পাচ্ছি শেষ বলে কিছু নেই, ঘন্টা রিপিট করছে ঘন্টাকে,
কুন্ঠা রিপিট করছে কুন্ঠাকে—রেললাইনের
পাশে প্রশ্নচিহ্নের ফিরে ফিরে আসা…এটুকুই যৌনতা, এটুকুই জাউভাত আমার…