তিনটে পৃথক ভাবনা আমার মনে মেঘ আনে।
১) কর্তা/কত্রী/স্বয়ং-এর মৃত্যু
(death of the subject)
২) স্বার্থের মৃত্যু (death of self-interest ) আর
৩) আত্ম-কতৃত্বের মৃত্যু (death of self-mastery)।
এই উত্তরাধুনিক ধারণাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক কী? এই ভাবনামেঘের ঘনঘটা কিছুটা
কেটেছিলো সেদিন সন্ধ্যাশেষে একজনের প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় গায়ত্রী স্পিভাকের
কথোপকথনে। বিমানবন্দরে যাবার পথে খেলার মাঠের ধারে জ্যামে আটকে পড়া অবস্থায় গাড়িতে,
গায়ত্রীদি আরো কিছু বললেন। যেটুকু বুঝলাম এখানে সংক্ষেপে
লিপিবদ্ধ করি। ‘Death of the Subject’-এর ধারণাটা আসে ফরাসী দার্শনিক ও চলচ্চিত্রবোদ্ধা জ্যঁ-লুক নঁসির (Jean-Luc Nancy) লেখা থেকে। দুঃখের কথা
স্বল্পপড়ুয়া বাংলা কবিতা একেই ভালোভাবে না জেনে/বুঝে, প্রকারান্তরে ‘বিষয়ের
মৃত্যু’ বা ‘কবিতায় বিষয় বলে কিছু হয়না’ করে ফেলেছে। স্বয়ম্ বা কর্তা/কত্রীর মৃত্যু বললে লেখার আগেই
কলমটাকে ভেঙে দেওয়া হয়, গায়ত্রীদির মতে – legitimacy
by reversal। সুতরাং এই ধারণাটাকে মূলেই বাজেয়াপ্ত করতে হয় অসিদ্ধ যুক্তি হিসেবে। বাকী যে দুটো ধারণা, সেই প্রসঙ্গে অধ্যাপক
স্পিভাকের বক্তব্য ‘এ দুটো কিন্তু এক নয়। ‘স্বার্থ’ আর ‘আত্ম-কতৃত্ব’ এক জিনিস নয় আর তাদের মৃত্যু হলে যে পরিস্থিতি
উপনীত হয় তাও এক নয়’।
‘সত্য’ ও ‘জ্ঞান’ বা ‘knowledge’ এর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে লাকঁ একটা কথা বলেছিলেন – এই যে ‘সত্য’ জ্ঞানের
মাছের চোখ, অজ্ঞান ও তার ফলিত কৌতূহলকে কাজে লাগিয়েই জ্ঞান তাকে অর্জন করে মাত্র। ফ্রয়েডীয় অচেতনকে উল্লেখ করে লাকঁ মনে করেন যে
অনেকগুলো সিগ্নিফায়ার বা ‘গুরু’ মালার মতো জুড়ে জুড়ে অচেতনকে নির্মান করে। এবং দুটো স্পষ্ট অক্ষের মাধ্যমে এই অচেতন গড়ে ওঠে –
অ) রূপক (metaphor) ও আ)
লক্ষণালঙ্কার (metonymy)। রূপক কী করে? ‘গুরু’র
পরিবর্তক খোঁজে। আর লক্ষণা? একদল ‘গুরু’র সমষ্টিকে তার নিজস্ব সংজ্ঞা দেয়। রূপকতার
ধারণা সমলয়তা বা synchronism-এর কথা বলে যা মিলের মাধ্যমে আসছে। আর লক্ষণালঙ্কার বলে বিলয়তা বা diachronism এর কথা যা গরমিলের ওপর জোর দেয়। অচেতনের এই পূর্বস্থিতি প্রমাণ করে লেখকের অভিপ্রায়ের আগেই,
তার স্বয়ম্ গড়ে ওঠার আগেই ভাষার কাঠামো গড়ে উঠেছিলো। লেখার বা কবিতার বক্তা কে,
কন্ঠস্বর কার? - এই সমস্ত প্রশ্ন অচল হয়ে পড়ে যেহেতু অচেতনের স্বয়ম্ সম্বন্ধে আমরা সন্দিগ্ধ। এক ভিতরি-বলা থেকে যাচ্ছে দুটো স্বয়ম্ এর মাঝখানে। আর এখানেই চুরমার হয়ে যাচ্ছে ধ্রুপদী স্বয়ম্ এর স্বচ্ছতা। ‘এক্রিত্স্’ গ্রন্থে এক জায়গায় লাকঁ বলেন – ‘an enunciation that denounces itself, a statement that
renounces itself, an ignorance that sweeps itself away, an opportunity that
self-destructs – what remains here is not the trace of what really must be in
order to fall away from being?’।
স্বয়ং, স্বেচ্ছা, লেখকের অভিপ্রায় ও প্রয়াসের এই সমস্ত বিভাজন, দ্বন্দ্ব,
সংঘাত, স্ববিরোধ ও সন্দেহ বাংলা উত্তরাধুনিক কবিতার পূর্ববর্তী আলোচনায় কতোটা
রয়েছে- এ সম্বন্ধে গভীর এক সন্দেহ নিয়ে এই রচনা লিখতে বসেছি। গায়ত্রী স্পিভাকের বক্তৃতা, ওঁর সাথে সামান্য
আলোচনা ও পরবর্তী পড়াশোনা এই সন্দেহকে প্রগাঢ়ভাবে উস্কে দিয়ে গেছে। উত্তরাধুনিক বা অধুনান্তিক বাংলা কবিতার আলোচনার
অনেকটা ব্যয় হয়েছে কবিতার উপসর্গ ও লক্ষণাবিষ্কারে। অর্থাৎ কী কী উপসর্গ বা প্রবণতা থাকলে কবিতা
উত্তরাধুনিক? সাহিত্যে, বিশেষত কবিতায় ‘উত্তরাধুনিকতা’ কোনো সচেতন আন্দোলন ছিলো না
কোনোদিন, কোনো দেশেই। পশ্চিম থেকে একান্ত নিতেই যদি হয়, আগে সাহিত্যতত্ত্বের গভীরতম গুহায় প্রবেশ
করার প্রয়োজন ছিলো। তাকে বুঝে নেওয়ার দরকার ছিলো পূর্ণাঙ্গভাবে, সমসাময়িক কিছু বাংলা কবিতার
আঙুলে তার অভিজ্ঞান-অঙ্গুরিকা পরিয়ে দেবার আগে।
এটা নিয়ে অনেক কথা বলা যেতে পারে, ওক্তাবিও পাস নিয়ে লেখা পড়া করতে গিয়ে পড়লাম মিশেল ফুকোর কোর্টে, সেখানে থেকে হাইডেগার, এবং দর্শনশাস্ত্রের এক দীর্ঘ ক্লাস করে ফেললাম। সেখানে দেখা গেল সবের পিছনে রয়েছে নিটশের ঈশ্বরের মৃত্যু নামক ধারণা। আমাদের ফলিত ভাষাতত্ত্বে, এ নিয়ে দীর্ঘ চর্চা। সাবজেক্টকে প্রতীকে ধরে পার্সনাল প্রোনাউন, সেখানে কবিতা লতিয়ে ওঠার সুযোগ অনেক। ভাবো, আমি, তুই, তুমি, সে, মরে গেছে!
ReplyDeleteআচ্ছা। সেটাও ঠিক। মনে পড়ছে। বোধহয় শিলারের কবিতায় ছিলো, নিঝ্চির (Nietzche) তত্ত্বের প্রতিফলনে লিখছেন যে ঈশ্বর মৃত, তাই মানুষের চিন্তা নীতিজ্ঞান মুক্ত। তবে 'আত্ম-কতৃত্ব'-এর জায়গাটা জটিল। বিশেষ করে তাকে উপনিষদ, অদ্বৈতবাদ বেদান্তের আলোয় দেখলে। এমনকি সাংখ্য দর্শন, যার কথা গীতায় উদ্ধৃত করছেন শ্রীকৃষ্ণ। যে 'আত্মণ' তার ওপর তো আসলে কোনো কতৃত্ব হয়না। আত্মণ তো 'ব্রাহ্মণ'-এর একাংশ যেমন তেমনি তার গোটা অভিজ্ঞতা জগত ও অভিজ্ঞতা ত্রিকালের পরিমাপক, পর্যবেক্ষক। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক। কাজেই 'আত্ম-কতৃত্ব' ব্যাপারটাই তো পশ্চিমী সংজ্ঞা নয় কি? আমাদের দর্শনে আত্মণের ওপর কিছু নেই। কাজেই আমার মনে হয় আত্মণের প্রকৃতি সম্বন্ধে সুনিশ্চিত জ্ঞানের উন্মেষ যখন হয়, তখনই এই প্রাতীচ্যিক 'আত্ম-কতৃত্বের' মৃত্যু হয়। অদ্বৈতিন কি বিশ্বাস করে? যে মায়ার বোধিই যন্ত্রণার কারণ। একমাত্র নিশ্চিত জ্ঞানই মায়াকে বিনাশ করে। আত্মণের উপস্থিতি স্পষ্ট হয়। ব্রাহ্মণ তার কাছে অবনত হয়।
ReplyDeleteami pUb poshcim-e jaabo naa... nijeder synthesis ke-i dekhbo... kakhono oggya important mone hoy... aajker quantum science theke universe oriented thinking theke person centered thinking theke bhaabbo...synthesis korbo eiTaai ultimate... tobe hNya prathame pora darkar... poRa o taake reject koraa...
ReplyDeletesabya
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteআরও পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
ReplyDelete****
সন্দেহ করি নিচ্চের 'ঈশ্বর' প্রতীচ্যের ঈশ্বর না। সুতরাং 'ঈশ্বর মৃত' কথাটা থেকে খাল কেটে বের হয়ে আসা অন্যান্য অনেক কথাই সরাসরি প্রতীচ্যের সংশ্লেষে কম্পোস্ট করা সম্ভব না, বা করলে বোকামি হবে। সুররিয়ালিজমের সময়ও নীতিজ্ঞানকে অবচেতনের রাস্তায় একটা বিরক্তিকর বাধাবিশেষ বলে মনে করা হইতো। দালির খুব মজার একটা কথা এইখানে হয়তো লিখলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না - ওনার নিজের ভাষ্যমতে উনি রাস্তাঘাটে অন্ধ/লুলা মানুষ দেখলে লাথি লাগাতো, যেহেতু উনি সুররিয়ালিস্ট, যেহেতু উনি নীতিজ্ঞানমুক্ত :-) । কিন্তু 'নীতি' বলতে আসলে সুররিয়ালিস্টরা কী বোঝাচ্ছে সেইটা কিন্তু স্পষ্ট না। নীতি মানে কি আমাদের আমাদের ভিতরকার নীতি? জঙ্গলে মরাল নাই? কোনো জংলি মরাল? সেইক্ষেত্রে বলতে হবে নীতিজ্ঞান মুক্তি আসলে চাওয়া হচ্ছে না, চাওয়া হচ্ছে নতুন কোনো নীতিজ্ঞানের চুক্তি, নিজের স্পিশিজকে একটু কম গুরুত্ব দেওয়া কিছু।
অর্থাৎ, উপরের তিনটা পয়েন্টে লেখা 'মৃত্যু' শব্দটাকে খুব সহজে 'জন্ম' দিয়ে রিপ্লেস করা যায় যেনঃ
১) কর্তা/কত্রী/স্বয়ং-এর জন্ম
২) স্বার্থের জন্ম
৩) আত্ম-কতৃত্বের জন্ম