'নতুন কবিতা'র বইমেলা-২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত।
===================================
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
আর্যনীল মুখোপাধ্যায়
সে দেখেছিলো। বড় হবার পথে এইসব। দেখেছিলো মদে ঈষৎ লালফোলা মুখের বাবার রাগ আর নতুন করে বোঝা যায় না। রঙের পোঁচ বাড়ে না। কয়েক সেকেন্ড ঝড়ের আগের নিশ্চল বাবা আচমকা মাকে টেনে নিয়ে পাশের চিলেকুঠরী ঘরের খিল বন্ধ করে। মার চিৎকার সে ভাইবোনেদের কানে চিনির জলে ভেজা তুলো গুঁজে চাপা দেয়। বরফ জলে পরের দিন ভোরে সে মায়ের রক্তপশম কাচে। পড়শিদের ভিড়েই কাচে। আর কাঁপতে থাকে হিমে না লজ্জায় না ভয়ে!
আর চোখ দিয়ে তার কাচের পুঁজ পড়ে। পড়শিদের মহিলারা ভাবে সে নতুন রজস্বলা। তারা হাসে। আর একজন যে স্থূলকায়া সে এসে জড়িয়ে ধরে। পুঁজ পুছে দেয়। চোখের কোল শুকনো করে। আর কাচামহল ফাঁকা হলে তার কাচাকাপড় টেনে মেলে নিজেই দড়িতে দেয়। তাকে মনে করিয়ে দেয় আসছে সন্ধের তুষারপাতের কথা। তারপর সে তার মাথাটা। যত্নে কম। সোহাগে বেশি। টেনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে । আর এক সময় যখন এদিক ওদিক চেয়ে বুকের জালিবাঁধন খুলে নিজের মাইতে তার মুখ ঘষতে থাকে - জোজিমা আবার নতুন করে আতঙ্কে ডোবে। বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। বাড়ি পালায়। কাচা কাপড় শুকোবার আগে রাতের ঠান্ডা স্ফটিকে স্ফটিকে ভরে যায়।
সে আরো দেখেছিলো। তার বাবাকে। মাকে আস্তাবলে অশ্বপুরীষের খড়ের ওপর ক্রোধে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে। মায়ের চিৎকারের ওপর বাঁ হাতের থাবা মেরে নৈঃশব্দ্য সাময়িক। ততক্ষণে বাবার ডানহাত ডনের পুষ্ট লিঙ্গ সঞ্চালন করে। ডন যন্ত্রণায় বা উত্তেজনায় চিহিহি করে ওঠে বার কয়েক। একসময় বাবা দুহাতই ওপরে তুলে নেয় আর মায়ের বন্ধ্যা চিৎকার সাকার হতে না হতেই ডনের একরাশ বীর্যে তা ঢাকা পড়ে। খড়ের গাদায়, অশ্বপুরীষের মধ্যে শুয়ে ছটফট করা মা; মায়ের মুখ, ও বিশেষত চোখ সেই ক্ষার বীর্যে বন্ধ হয়ে যায়। কান্না যতক্ষণে বাঁধ ভাঙে বাবার অট্টহাসি তাকে সাপের মতো পরিবেষ্টন করে নিশ্চুপ করেছে। এসব সে দেখেছে। বারবার না হলেও এক আধবার। আর জোজিমার চোখ দিয়ে কাচের পুঁজের জন্মবৃত্তান্তও এখানে। এভাবেই।
=====================================
- এমন প্রায় দেখাই যায় না যে তোমার ছবির চরিত্ররা তাদের অবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। একমাত্র “হোয়াইটি” ছবিতে এটা হয়, যেখানে এক দাস তার মণিবকে খুন করে পালায়...
রাইনার ওয়ের্নার ফাসবিন্দার – হ্যাঁ, অথচ ছবিটা কিন্তু কালো মানুষদের সমালোচনা। কেননা তারা সবসময় দোনামনা করছে আর লড়তে ভুলে যাচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। লোকটা খুন করে ঠিক, কিন্তু মরুভূমিতে গিয়ে লুকোয় তারপর, আর শেষে মরে, অন্যায় সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠার পরেও তার প্রতিক্রিয়া আসেনা................................. ছবির শেষে একটা এককক্রিয়া কোনো কিছু সমাধান করে না, বরং ছবিটাকে খারাপ করে। তাই আমার ছবিটা কিন্তু শেষমেশ কালোদের বিপরীতে যায়।
======================================
আর বাই দ্য ওয়ে, “ডন” ছিলো বাবার প্রিয় ঘোটক। মেয়েদের পেছনে পেছনে ঘুরলেও, কম্যুনিস্ট মাঝিদের ঠেক থেকে তাদের বর্জিতা বেশ্যাদের পরিত্যক্ত গোলাঘরে নিয়ে গিয়ে সরবে মজা করলেও, বাবার প্রধান অসুখ যে ছিলো “ঘোড়ারোগ” সেটা জানা যায় এইরকমই এক শীতে। যেবার কার্ডিনাল বেঞ্জামিনের সহিস তাদের সাজানো ফিটনের তিন নম্বর ঘোড়াটাকে চাবুক মারতে মারতে প্রায় আধাখানা শরীর মাটিতে। বাবা রাস্তায় ছিলো। কারখানার গেটে। কফিমাগ হাতে ব্রেকের সময়। সহিসের চাবুক কেড়ে নেয়। কাদাবরফের আস্তর সরিয়ে দেখায় ঘোড়ার পেছনের রাঙের চোট। হাড় তো ভেঙেছিলোই, ফ্যাকাশে রক্তে বরফকাদার প্রলেপে বেচারা অবলার ঠ্যাঙ অল্পগোলাপী হয়েছিলো। এইসময় মহামান্য বেঞ্জামিন বেরিয়ে আসে ও দয়ালু মর্মময় বাবার কৃপাহস্তের পরম প্রযোজনা দেখে ঘোড়াটা বাবাকে দান করে।
বাবাকে সে সেইসময় সাহায্য করেছিলো। সে। জোজিমা। পরম মমতায় ভালো করে তুলেছিলো ঘোড়াটাকে। কয়েক মাস রোজ। নিজেদের খাবার বাঁচিয়ে “ডন”, যা তার নাম হয়েছে ততোদিনে, তাকে খাইয়ে সুস্থ ক’রে তোলে। তারপর গোটা শহর একদিন বসন্তে – যেদিন নতুন চেরিফুলে সব পবিত্র পথঘাট সাদা – সেদিন গোটা পরিবার – ওরা ঘুরেছিলো বাবার তৈরি নতুন ঘোড়াগাড়িতে। খুরের শব্দে সেদিন গির্জার ঘন্টা চাপা পড়েছিলো। কাঁচাকাঠের গন্ধে সেদিন শীতের প্রার্থনায় বসন্তের মুখর উত্তরের সবটা শোনা যাচ্ছিলো। আর পরের দিন ভোরে প্রথম সে চড় খায় মায়ের হাতে। আর বাবার হাতে এমন মার... যা...
শহরপ্রান্তে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে সেদিন এক আজব দোকান থেকে বাবা তার কেনে, অদ্ভুত দেখতে বাটির মতো অ্যালুমিনামের কি যেন একটা – তার মাঝে আবার গোলগর্ত – আর একটা কাচের বলের মতো – তাকে নাকি “বাল্ব” বলে। ফিরে এসে ঘরে তাদের সেদিন প্রথম শিল্প আন্দোলন হয়। বাল্ব জ্বলে। অ্যালুমিনামের শেডের নিচে। রবীন্দ্রনাথের আলোবিষয়ক সমস্ত গান – যেটুকু অনুবাদে কানাঘুষোয় ততদিনে তাদের বাসায় পৌঁছেছে – সকল সেসব গান, তোমাকে লক্ষ্য করে দর্শক, গাওয়া হয়।
মা বানায় কড়াইশুটির সুরুয়া। ফোকাচ্চিয়া রুটি আসে। কানাডার এল। টেবিলের প্রার্থনা সেদিন কয়েক সেকেন্ডে সেরে তাদের কী সে আনন্দ! কী সে ভোগ! কী সে তৃপ্তি! আলোটা এমনিতেই ফিকে হয়ে আসে রাতে। কিন্তু বাবা নেভাতে দেয়নি। প্রথম দেখার জ্যোতি-উত্তাপ সবার মধ্যে ছিলো। আর সেই ফিকে হয়ে আসা আলোয় সে। জোজিমা। সামান্য দরজার এক প্রিজম্যাটিক চিলতে দিয়ে দেখেছিলো বিবদমান মানুষের আলোকপ্রাপ্ত-প্রাপ্তা সে নৈশ ভালোবাসা।
সেদিন সে। জোজিমা। বুঝেছিলো তার আর তার ভাইবোনদের জন্মরহস্য। বুঝেছিলো তাদের জন্মের নেপথ্যে নির্মমতা নয় বরং ঈশ্বরকে তাক লাগানো প্রেম ছিলো। মমতা। বাবা যে মাকে করছিলো এটা কখনো মনে হয়নি। হয়েছিলো পুরুষের ভালোবাসার বয়ান রচনা। তার মুদ্রার গড়ন দেখা। তার যত্নের গড়ে ওঠা। আর তাতে মিল দিয়ে, ছন্দ দিয়ে, লিরিককে গুছিয়ে দেওয়া নারীর গোটা আদবটাই তার সেদিন সেই প্রথম। সেদিন সে। জোজিমা। প্রথম নিজের যোনিতে নিজের আলতো হাত রাখে। মা-বাবাকে দেখতে দেখতে।
সেদিন সে। জোজিমা। আবার অবাক চোখে বাল্বের ওই বিস্ময়কর নতুন প্রযুক্তি-দ্যুতি আবার দেখে। তার মনে হয়েছিলো সত্যিকারের স্বপ্ন কারখানাতেই আসলে তৈরি হওয়া সম্ভব। লোহার কারখানায়। খনিজের কারখানায়। কাচের কারখানায়। শরীরের কারখানায়।
=================================
তুরেন্ত এরপর ব্যুনিউয়েলকে জিজ্ঞেস করলেন, “কামনার অস্বচ্ছ বস্তুটি তাহলে কি? ওই নারী? তার উরু-স্তন? না তার আত্মা?”
ব্যুনিউয়েল – কে জানে? হয়তো তিনটেই। বা হয়তো নয়। হয়তো ফের্দিনান্দ যেমন খুঁজছে, তেমনি সেই মেয়েটি। বা হয়তো মেয়েটি দুভাবে খুঁজছে ওই দুই অভিনেত্রীর মধ্যে দিয়ে। আমি জানিনা। কামনার বস্তুটা তো অস্বচ্ছ, দুরুহ, তাই না ?
================================
সেদিন সে। জোজিমা। নিজের সদ্যোজাত বুক চেপে ধরতে গিয়েছিলো। দরজার গায়ে। আর তাতেই শব্দ হয়। দরজা নড়ে যায়। সরে যায়। এ ঘরের ফিকে বাল্ব বাবা-মায়ের চুমুর ওপর বিদ্যুৎ হয়। পরের দিন রবিবার। ঘুম থেকে উঠে টেবিলের কাছে যেতেই কেটলির ইঞ্জিন ধোঁয়ার সামনে থেকে সরে এসে মা সপাটে চড় মারে। আর টেবিলে চায়ের কাপ নিয়ে বসা বাবা...
সাপের মতো তার সোনালী বেনী টেনে তাকে ভাইবোনদের খাটের ওপর ফেলে পিঠের ওপর বাঁ হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে। সে প্রতিবাদ করেনি। শব্দ করেনি। সদ্য ভাঙা ঘুমের আঠায় সারা শরীর তখনো যে বিবশ! আর তা না হলেও সে চিরদিন পড়েই মার খাবার। বাঁ হাঁটু দিয়ে তাকে চেপে রেখে বাবা তার বেল্ট খোলে। ভাইবোনরা ততক্ষণে উঠে পড়েছে। এমনকি মিরান। যমজ ভাই মিরান। সেও তখন ষোলো। মাইনাস কয়েক মিনিট। সবার সামনে বাবা। শীতের ভোরের বাবা।
তাকে উপুড় করে স্কার্ট তুলে টেনে ইজের টেনে নামিয়ে দেয়। জোরে। তাতে ইজের ছেঁড়ে। ছোটোবোন শামীমা অভ্যাসবশত কচিহাতে চোখ ঢাকে। আর বাবা – আইভান সরকার - বেল্ট চালায় জোজিমার নগ্ন পশ্চাতে। দাগ পড়ে। লালদাগ। দগদগে হয়। পুরো এক সপ্তাহ সে ডিনারে টেবিলে বসতে পারেনি। উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে খেয়েছে। কিন্তু সেটা বড় নয়।বাথরুম করার কি অসহ্য যন্ত্রণা! শুধু সুরুয়ার ওপর থাকা যাতে কম যেতে হয়। মা একটা সবুজ রঙের পাউডার দিচ্ছিলো যাতে বায়ুবৃদ্ধি না হয়, কেননা বায়ু-নির্গমনেও বেদনা। সহস্র সূচ যেন সেলাই মেশিন থেকে বেরিয়ে এসে তার নিতম্বে পিরানহা। মিরান বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়লে সেদিন সকালে কি হতো সেসব দুশ্চিন্তাও নয়। অন্য একটা বরং। অন্য একটা কথা ভাবলে আজো তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়। মায়ের ওপর রাগ বাড়ে বেশি। নিজের জন্মদিনটাকে জোর করে ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে...তুলে দিতে...
মিরান যখন বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কেউ দেখেনি ঘরের দরজা অল্প ফাঁক হয়েছিলো। একটা মুখ ঢুকে এসেছিলো। গারসিয়ার মুখ। তার বাচ্চা মুখের ভারী চশমা। সেও কি দেখেছিলো ছাই! জোজিমা। সে তো তখনো দরজার দিকে ল্যাংটো আহত পশ্চাত দিয়ে বিছানায় মাথা রেখে আধা-মুর্চ্ছায়। কোনোদিন ঘনিষ্ঠ হবার আগেই গারসিয়া তার রক্তাক্ত নিতম্ব দেখলো এটা দুঃখ বেশি না যন্ত্রণা, অপমান বেশি না গ্লানি – এসব সে –জোজিমা - আজো ভাবে। ৯৮ বছরের কখনো বিকেল।
ততোদিনে মা আলোকচিত্রি হিসেবে বিখ্যাতা হয়ে উঠেছে জেলাশহরে। আর সে মায়ের সহকারী। সহচরীও। জ্যঁ-ক্লদ বাবুল তার বর্জিত দোকানের যে কন্টেসা ক্যামেরাটা মাকে দান করেছিলো, যে ক্যামেরা টিনের তোরঙ্গে মা লুকিয়ে রাখতো, বিয়েবার্ষিকীর শুকনো ফুল একটা, গভীর রাতে ক্যামেরার পাশে রেখে যেত, যেত সৌরভের ভিক্ষায়, দেখার চোখ যাতে সুগন্ধীও হয় সেই প্রার্থনায়; আর একবার রাগের মাথায় যে ক্যামেরা বাবা জোরজবস্তি চাইতে গেলে মা সেলাই হাতকল মাথার ওপর তুলে বলেছিলো – মেরে মাথা থেঁতো করে দেব – সেই ক্যামেরা যে ততদিনে মায়ের হাত, সেই মেচেতার হাত, যার সমস্ত অপহৃত কোমলতা কিভাবে যেন ফিরে এসেছে – সেই হাতে – সেই হাত যা অন্ধঘরের লালবাতির আভায় স্বপ্নের মতো।
============================================
সেই স্বপ্নের মতো যার কথা ইঙ্গমার বেয়ারম্যান বলতেন; নিজের শরীরের ভেতরটা দেখতে চাওয়ার কথা - ছেলেবেলায় যখন ওঁর স্কার্লেট-জ্বর হতো, জ্বরের ঘোরে ওই রকম দেখতেন, নিজের শরীরের ভেতরটা হাজারো রক্তাক্ত শেডে নির্মিত; হাজারো রক্তিমাভার বন্যায়, আলোকের ওই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দেবার মতো; যা শেষ পর্যন্ত তিনি “ক্রাইস অ্যান্ড হুইস্পার্স” ছবিতে, কান্না ও ফিসফিসানির ছবিতে এক অনপনেয় ভাবনার মাধ্যমে, উপায়ে ব্যবহার করলেন – সেটের সমস্ত আসবাব তৈরি করলেন নানা ধরণের লালরঙে
============================================
সেই রাঙাঘর, সেই ক্যামেরা ততদিনে মাকে দিয়েছে এক সৃষ্টিজীবন, আর সে। জোজিমা। তার সহচরী। সহকর্মী। সহকারী।
ততদিনে সে উনিশে পড়েছে। সে। জোজিমা। তার হাতে ফিল্মের কেমিকালের গন্ধ। ইথারের ঘ্রাণ। এ-জি-বি-আর। সিলভার ব্রোমাইড। রূপালি তার হাতের পুতুল। নীল তার চোখ। নীল ব্লাউজ। ছোট্ট হাঁ-মুখ। স্নান করার আগে আয়না দেখায় তার বৃন্তের রঙ ধরা-ক্রিমসন।
হ্যাঁ বাথরুমে ততদিনে আয়না এসেছে। কাট-কাচের আয়না। মেহিকো-সিটি থেকে। এসেছে মায়ের আলোকচিত্রের যাদুতেই। রোজগারে। আর সেই সময়েই একদিন বাজারের একপাশে জ্যঁ-ক্লদ বাবুলের দোকানে এ-জি-বি-আর কেনার সময়ে গারসিয়া দোকানে ঢোকে। ওকে দেখতে। ক্লদ বাবুল তাকে শুধায় – কি চাই ছোঁড়া? আর গারসিয়া তাকে দেখায়। সে। জোজিমা। গালে তার আপেল ফলে। জ্যঁ-ক্লদ তার বাইফোকাল দিয়ে দেখে আর মুচকি হাসে। বলে – বঁ!
আর বোঁ করে সে গারসিয়ার হাত ধরে তাকে কপট বকুনি দিতে তাকে টিনের দরজা ঠেলে নিয়ে যায় দুর্গাবাড়ির ভেতর। দরজা ভেজানো থাকে। সে তাকে মঞ্চের ওপর নিয়ে যায়। লাজুক চোখে চায় আরেক লাজুক চোখ। দরজার দিকে দু-একবার চেয়ে সে তাকে ঠিক কানের নিচে চুমু খায়। গারসিয়ার চশমা হয়েছে ততদিনে। গারসিয়া কতো লাজুক হয়েছে! আচমকা কানের নিচে চুমু পেয়ে তার কান গুটিয়ে যায়। জোজিমার হাত ধরে। নাকের কাছে আনে।
- তোমার হাতে ফসফরাসের গন্ধ!
- মোটেই না। রূপো।
- যাঃ! রুপোর গন্ধ হয় না । ফসফরাসে হয়। আলো জ্বলে।
- আমার হাতে আলো জ্বলে বুঝি ?
- জ্বলে না বুঝি! তাইতো অত ছবি ওঠে।
- সে তো মা তোলে। আমি কি তুলি ?
- আমি দেখেছি বসপোরাসের জলে তুমি একদিন হাত ধুচ্ছিলে আর জল জ্বলজ্বল করছিলো। মাছ আসছিলো সে জলের খোঁজে।
- যাঃ! মাছ আসছিলো! মাছ আসবে কেন ?
- ওগুলো সাগরের মাছ। ওরা ফসফরাস চেনে।
- তোমার খুব সাগর ভালোলাগে, না ?
- আমি পর্যটকদের পছন্দ করি। নাবিকদের গল্প পড়ি।
- নাবিকরা মাছ চেনে বুঝি?
- হ্যাঁ, মাছ সাগরের কথা বলে।
- আর সাগর বুঝি ফসফরাসের ?
- আর ফসফরাস আলোর...
- আলো রূপোর...
- আর রূপ? ... ক্যামেরার
=======================================
সিনেমা দেখা এক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। আর শেষপর্যন্ত আলোকচিত্রই সিনেমার প্রধান মৌল। আলোর মানের হেরফেরে, তার মুক্তি ও বন্দিত্বের নিজস্ব শর্তে, মানব-ইতিহাস ও মানবচেতনার ওপর তার আসা যাওয়ার ক্রিয়াকলাপকে কতোটা গভীরভাবে নজরবন্দি করা যাচ্ছে, চলচ্চিত্রের আসল সোনা সেখানে। প্লট-ফ্লট বাজে কথা। গল্প বলার ইতিহাস কি? ভয়ে আত্মরক্ষার্থে মানুষ গল্প বলে... রাতের পর রাত একটা খুনীকে বিরত করতে মানুষ গল্প বলে। কচুকাটা হবার ভয়ে হাজার রজনী কেটে যায়।
মনভাবনা গল্প বলে না। মানবচেতনা আলোয় রচিত। দেয়ালের ওপর একটার পর একটা প্লেনের মুহূর্তছায়া ফেলে যাওয়াই যুদ্ধ। আলোরশ্মির যাত্রা আর জায়গায় জায়গায় তার বায়ুছাপ গড়ে তোলাই গল্প। আর ক্যামেরাই সে কাহিনির একমাত্র লিখিয়ে ও শুনিয়ে।
আমাদের ছবি দেখা – সব পাস্তিশ...
===
অনুপ্রেরক
১। ফোর শর্ট স্টোরিস বাই ইঙ্গমার বেয়ারম্যান, ইঙ্গমার বেয়ারম্যান, ইংরেজি অনুঃ, মারিয়ন বয়ার্স, স্টকহোম-নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৪।
২। অবজেক্টস অফ ডিসায়ার, ইন্টারভিউস উইথ ল্যুই ব্যুনিউয়েল, মারসিলিও প্রেস, নিউ ইয়র্ক, ১৯৮২।
৩। রাইনার ওয়ের্নার ফাসবিন্দার, দ্য মিউসিয়াম অফ মডার্ণ আর্ট, নিউ ইয়র্ক, ১৯৯৭।
৪। এভারলাস্টিং মোমেন্টস, এ ফিল্ম বাই জান ট্রোয়েল, ক্রাইটিরিয়ন কালেকশন,২০০৮।