Sunday, December 18, 2016



উত্তর / নীলাব্জ চক্রবর্তী

১৫/১২/১৬

সিনেমার ভেতর আমরা
ভেঙে ফেলছি জ্বরের একক দশক
যেটুকু ঠোঁট
আলো ফিরিয়ে দিচ্ছে
নূর-উজ-জামানের গলিতে
একটা বয়স     প্রাপ্ত হচ্ছে না কিছুতেই
আবার অ্যাতোদিন বাদে
কীভাবে পেরিয়ে যাব আপেল ছুঁয়ে রাখা
ভাবতে ভাবতে
চেকলিস্ট
এই তো নিজেকে ভরে ফেলছি
বাক্সের ভেতর
ছায়া তুলতে গিয়ে
আরেকটু এগিয়ে আসছে কেউ
সহজ সময়গুলো কেটে ফেলছে...

১৪/১২/১৬

একটা নদীর তেতো নাম নিয়ে
ফ্রেম একবারই এসেছিলো
গানের ভেতর
সকালের গ্লিসারিন ভুলে
এই শীত এই উচ্চারণ আসলে
পোলিটিক্যাল
যতোটা বড় করছে জলের এই দাগ
লেখা ছিঁড়ে গেলে
টাচ টু রিট্রাই লেখা আছে তো
এভাবে মনের একটা ভেতর হয়
দ্যাখো কবিতা ব্যক্তিগত হচ্ছে
আর
নামতায় ঝুঁকে আসছে
কুশলী বিনিময়গুলোর না-দেখা...

১৩/১২/১৬

দূরের আয়না থেকে              কতোটা কাছে
তোমরা ছিলে
অন্যের হাত মকশো করা কবিতায়
তোমার স্বাভাবিক ভেতরে যতটুকু
সম্পর্ক অবধি একটা রাস্তা
শক্ত হয়ে উঠছে
ভাষার যেদিকে
বারবার হাত চলে যায়
ঘুমের যেদিকে...

১২/১২/১৬

তাহলে স্মৃতি শেষপর্যন্ত একটা রোদে ছাপানো কাগজ হয়ে থেকে যাবে তারপর নর্থলাইন বরাবর দূর থেকে ভোর এগিয়ে আসবে আর প্লট প্ল্যানের সামগ্রিকতা নিয়ে হোটেল জানলা ঠেলে ঢুকে পড়বে ক্রমাগত বিনিময় হতে থাকা স্থানাংক বিন্দুগুলো কথা তখন পালক কাউন্টার জুড়ে সাজানো আলাদা আলাদা রঙের দিন বেছে নিন পুনর্নির্মাণের জন্য অর্ডার করুন এই ভাষা

অথচ স্মৃতি আর সরণী থেকে
যতটুকু মাপে-কাটা হাওয়া
মাংসের ভেতর আর বাইরে
লিফটের দিকে এগিয়ে যাওয়া
একটা যেন কতো ম্যাচিওরড বিকেল
ঠাণ্ডা হয়ে আসে
আমাদের ছায়াগুলো
এমনি এমনি
পড়ে থাকলো...

১১/১২/১৬

ভারী হরফের ভেতর
তাপমাত্রার ভেতর
ভেসে উঠছে একটা পুরনো দুপুর
আর বোতামের দরজা
ওখানে ঘন হয়ে আসে
স্নায়ু শব্দটায়
কাকে যে উপত্যকা বলি
নেমে যাই
নিজের ছায়ার থেকে দূরে
ধোঁয়াটে স্মৃতির
এক উইন্ডো সিট
যতোটা বড় হয় ক্ষিদের আঙুল...

Friday, September 9, 2016

তদোগেন গিরতের কবিতা

তদোগেন গিরতের কবিতা-৪০

তুমি যাকে আলো বলে ভাব
আর সে যাকে আলো বলে দেখে
তার মাঝে প্রহর কে প্রহর বোবা দূরত্ব
সে’ই ব্যবধানকেই আমি আলো বলে জানি
তুমি আমায় অসাড়ত্বের মধ্যে বসিয়ে রাখ
আর অনুভূতির কথা শোনাও
আমার খরখরে ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে দিতে দিতে
আত্মস্থ হও আর আমার ক্ষিদে-তেষ্টা ভুলিয়ে দাও
আমি জানি পাঁচমিনিট পরে লোহার ড্রয়ার
খুলে তুমি আবার বেরিয়ে আসবে
পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেকে টিকিট খুলে
বাড়িয়ে দেবে কন্ডাকটারের দিকে
একবগগা টানেল দিয়ে এই আমাদের গাড়ি
রীয়ারভিউ-এ খামারবাড়ির, কবরখানার আলো

  
তদোগেন গিরতের কবিতা-৪১

অবশেষে পুরোনো ক্ষত মুখ খুলছে
শ্বাস নিচ্ছে আর কথা বলে উঠছে
নতুন ক্ষতর সাথে আর অবশেষে
রিপুর মত, অনুযোগের মত
বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছ তুমি
অবশেষে তারে টাঙ্গানো সাদা কাপড়েরা
রঙ্গীন হয়ে উঠছে বাতাসে
আর ইঙ্গিতের ভেতর গুটিসুটি মেরে
ঘুমিয়ে পড়ছে মানুষজন
স্বপ্নের ভেতর আলো, আলোর মধ্যে
বেঁকে ঢুকে যাওয়া রক্তের রেখা
আর সাদা এপ্রনে দাঁতের ডাক্তার
শেকড় অব্দি সেঁধিয়ে যাচ্ছে
আমার মুখ ভরে উঠছে শাঁখের গুড়োয়
পোড়া গন্ধে, কুলকুচি করে যন্ত্রণা
ফেলে দিচ্ছি আর ডুকরে উঠছি
যন্ত্রণার খুব বাইরে ক্ষতচিহ্নের
 
মত একা ও অধীর হয়ে উঠছ তুমি


তদোগেন গিরতের কবিতা-৪২

অথচ সে আমায় ঘুরে দাঁড়াতেই বলে
মৃদু অবসাদের তার পারফিউম
আর মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত তার রক্তাল্পতা
ঘরের ভেতর থেকে একটা ভেজা কাঠের গন্ধ
ভবিষ্যতে চারিয়ে যায়
আর আমি কড়ি-কব্জায় তেল ঢালি
মচমচে সিঁড়ি দিয়ে সেই বাতাসে
ঘুরে বেড়াই, যে বাতাসে শ্বাস নিই
এই হাওয়া ও ছাইয়ের জগতে আমি বড়জোর
এক দিকনির্দেশ—রক্তশূন্য গাল ফুঁড়ে
উত্তরের দিকে তাকিয়ে রয়েছি


তদোগেন গিরতের কবিতা-৪৩

আমার টেবিলে বসাবার মত ঈশ্বর পাচ্ছি না
আমার বিছানায় শোয়াবার মত ঈশ্বর পাচ্ছি না
দু’হাতে বুদ্বুদ সামলাতে সামলাতে দাঁড়িয়ে রয়েছি
নিজের কবিতা হাতে সাবধানে দাঁড়িয়ে রয়েছি
মোড়ক খোলা সাবানের সামনে হতবাক সাবান-ব্যাপারির মত
আর তোমরা ভেবে ফেলছ--এটাই আমার স্টাইল

পার্লামেন্ট থেকে হাওয়া আসছে
পাথর পার করে হাওয়া আসছে
সার্কাসের তাঁবু আর মাংসের দোকান
পার করে হাওয়া আসছে

কী ভীষণ হিংস্র
কী চমৎকার আমার নিঃসঙ্গতা
একরোখা বুদ্বুদ সামলে যাচ্ছি
নিজের কবিতা সামলে যাচ্ছি

  
তদোগেন গিরতের কবিতা-৪৪

কোত্থেকে এসেছ তুমি?
পেছন-বাগানের ধুলো-ধক্কড় থেকে?
খাটের নীচের তোরঙ্গ থেকে?
বসন্তের অ্যামস্টার্ডাম?
গলত পার্টির অপ্রস্তুত টাক্সিডো?
তুলোর ভাল্লুক?
অগ্নিনির্বাপক?
নাকী সেই তেতাল্লিশটা কবিতা--
যার আগাপাশতলা শুধু ভুলের ফিরিস্তি
ভুল, যে ভুল আমায় ভুট্টার চিপ্স খেতে দেয়
কালো কফির সাথে, আর দুপুরে
মটর স্যুপের সাথে প্যান কেক
ভুল, যে ভুল সারাদিন
আমায় বসিয়ে রাখে পোর্চে
দোলনায় আর সারাক্ষণ আমাকে দিয়ে
প্রশ্ন করিয়ে যায়
দৃশ্য থেকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে
আমাকে অবধারিত অন্ধ্বত্ব থেকে
প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে যায়...

Monday, February 22, 2016

মঙ্গোল কবি তদোগেন গিরতের কবিতা



পরিচিতিঃ
তদোগেন গিরতে পেশায় শিক্ষক। মঙ্গোলিয়ার ওন্দোরহান বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পারেটিভ লিটারেচার পড়ান। কবিখ্যাতি সেভাবে নেই। কোনো প্রকাশিত বই নেই। সময় কাটানোর জন্যই লেখালিখি করেন। তাঁর নিজের কথায়; কবিতা নিয়ে সেরকম কোন অ্যাম্বিশন নেই। তা’ছাড়া আমার লেখাগুলি যে আদৌ কবিতা—মঙ্গোলিয়ার কোন দৈনিক বা পত্রিকা সে কথা স্বীকার করে না। 


তদোগেন গিরতের কবিতা- ১

আমি নোংরা মেয়েদের কাছে যাব
কাঠের নথ নিয়ে যাব
আমার বাহুর মাংসে গিঁথে গোবি ভাল্লুকের দাঁত
আমার কোন নিষেধ নেই

আমি নোংরা মেয়েদের মুখের ভেতর
ঘুরে দাঁড়াচ্ছি, আর কাঁপছি
কোঁচকানো মুখের চামড়া টান করে দিচ্ছি
আমার কোন নিষেধ নেই

ঘাসের মধ্যে উঠে দাঁড়াচ্ছে সারস
ওর চোখের পাতা লাল
ওর পিঠের রঙ কালো
চকচকে দুই দাবনার মাঝে সবচে মিষ্টি ওর পুটকি


তদোগেন গিরতের কবিতা-

আমার নাম তদোগেন গিরতে
তদোগেন গিরতে বলে কেউ নেই
আমার বৌ দুশ্চরিত্তির
আমার বৌয়ের বোঁটা খুঁড়ে দিয়ে যায় কাক

আমি স্তেপ পেরিয়ে আর নদী পেরিয়ে
নোংরা মেয়েছেলের কাছে যাই
আর দেখি ওর বিছানায় রাত্রি
আর দেখি ওর বিছানায় দু’পায়রাত্রিকেজড়িয়ে
বনশুয়োর

আমার বৌ দুশ্চরিত্তির
আমার বৌ বলে কিছু নেই
আমি নোংরা মেয়েছেলের কাছে যাই
পুরো মঙ্গোলিয়ায় কোন নোংরা মেয়েছেলে নেই।


তদোগেন গিরতের কবিতা-

সে সারাদিন তাইমেন মাছ কাটে
উবু হয়ে বসে ট্রাউট কাটে
ওর তলপেটে মাছের গন্ধ
আমরা দিনের বেলায় করি,
করার পর আমার তলপেট মাছ হয়ে যায়

রাতে যখন চিকচিক করে জল
আমার তলপেট বরফজলে সাঁতরে বেড়ায়
সে ভোরভোর তাকে খ্যাপলা জালে ধরে
আর কেটেকুটে বরফের ওপর রেখে দেয়


তদোগেন গিরতের কবিতা-

আমি পাল্লা বেড়ালের ধুমসো লোম
থেকে শব্দ বাছি
আমি আর্গালি ভেড়ার পেট কাটতে কাটতে
শব্দ তুলে আনি
আমি তথাগতর সামনে ধুপকাঠি জ্বালি
আর প্রার্থনা করি—দেবতা আমার একটা গান হোক
পপলার বনে পাতা নড়ে
গাঁয়ের বাইরের টিলায় লাল রং ধরে
আমি তুষার চিতার পায়ের ছাপ থেকে কান্না ছেনে তুলি
আর আমি শব্দ খুঁজতে উলান বাটোরে
মায়া খুঁজতে জুয়ার টেবিলে
আমার ভেড়ার চামড়ার ডিল শব্দে ভরে ওঠে
আমি তদোগেন গিরতে শব্দর পাশে শব্দ সাজাই
আর তাকে কম্বলের তলায় নিয়ে শুই
তার দু’পায়ের ফাঁকে উংলি করি
আর সে গানে সুর বসে

সেই গান সারাজ্যোৎস্না বরফের ওপর হেঁটে বেড়ায়
খুব ভোরে উলান বাটোরের রাস্তায় তার পায়ের ছাপ দেখা যায়
---

অনুবাদকের নোটঃ  (ডিল=মঙ্গোল ট্রাডিশনাল পোষাক)


তদোগেন গিরতের কবিতা- ৫

তথাগত তিনি করুণাময়
তথাগত তিনি তাঁর হাতের ছপটি
গুণেগুণে তিরিশবার আমার দাবনায়
তাঁর মূর্তির সামনে সে আমার ওপর উঠে পড়ে
আর করে আর করে আর করে
তার বোঁটা থেকে নুন বেরোয়
অথচ সমুদ্র এখান থেকে চারশো মাইল পুবে
চীনের জিনঝৌ আমি তদোগান কখনো যাইনি
আমি এক বসন্তে ম্যানহাটানে গেছিলাম
নিউ ইয়র্কের মেয়েরা আমার ভাষা বুঝতে পারেনি
ওরা আমার পিঠের, দাবনার কালসিটে দেখতে চেয়েছিল

নিউ ইয়র্কের মেয়েদের রঙ বেগনী ওদের চুলের রঙ সবুজ
ওদের বুকে নুন নেই, তথাগত ওদের করুণা কর


তদোগেন গিরতের কবিতা- ৬

আমি বল্লমে শান দিই
আমার মা হাড় ছাড়ানো বুদগের পেটের ভেতর
আরুলে মাখা টুকরো টুকরো ভেড়ার মাংস ভরে
ভেড়ার চর্বিতে খুশুর ভাজে
আর খসখসে গলায় গান করে
ধোঁয়া বেয়ে বেয়ে সে গান আকাশে উঠে যায়
সে গানের গন্ধে ঈগল ঝাঁপিয়ে পড়ে
আর ছিনতাই করে ভেড়ার মুন্ডু

সব্বার গান থাকে
বরফের নীচে মাটির একটা ঘুমঘুম গান
আলতাই পাহাড় আর আকাশের একটা দেখাশোনার গান
নদী আর নদীর মধ্যে থেকে শ্বাস নিতে ওঠা পাথরের গান
হাড়ের স্তুপকে আরপার করা বাতাসের একটা গান

সাম্পার পাঁজর থেকে
বেরিয়ে আসা গান
আমার বল্লমের ডান্ডায় থরথর করে
---
অনুবাদকের নোটঃ (বুদগ= একশ্রেণীর বড় কাঠবেড়ালি বা Marmot, আরুল= দই, খুশুর= ভাজা ডামপ্লিং, সাম্পা=নেকড়ে)


তদোগেন গিরতের কবিতা- ৭

কে আর কাকে চেনে তদোগেন?
কন্দ কি চেনে তার উদ্ভিন্ন পাতাদের?
আমি তোমাকে কীইবা দেব?
চিরুনি বুলিয়ে দেব কাকচুলে
চিরুনি বুলিয়ে দেব ছাইচুলে
জট ছাড়িয়ে দেব
উকুন বেছে দেব
আর কালকের সবুজপাতা
আজকের হেমন্তে মাটিকে চিনলো

উটগুলো কুঁকড়েমুকড়ে বসে আছে
ওদের ছায়ার মতিগতি আমি বুঝতে পারি না


তদোগেন গিরতের কবিতা- ৮

আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া চিন্তা
তুমি যখন দোরগোন হ্রদে ছিপ ফেল
আর বইয়ের শিরদাঁড়ায় হাত বোলাও
আনমনে আমি ঘাসের ওপর পাতা
কম্বল থেকে ছারপোকার মত উঠে আসি
৩৯-এএকলা জাপ সৈন্যের ক্ষমাপ্রার্থনার মত উঠে আসি

ওন্দোরহানের রাস্তায় আমি পিক-আপ চালাই
বার্চবনে পাতা উড়িয়ে যাই
তোমার থেকে এখন আমি ৫০০ মাইল দূরে
৭০০ মাইলের দিকে যেতে যেতে
পায়ের ফাঁকের শিরশিরানি ভাঁজ করে রাখি

আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া চিন্তা
তোমার চেয়ে কে’ইবা ভালো জানে
যৌনতা ভাঁজ করে রাখলে বই হয়ে যায়


তদোগেন গিরতের কবিতা- ৯

ঐ ছাই জিন্স আর বম্বার জ্যাকেটের
ছোকরা আমার কবিতা পড়ে না
ঐ নীল স্ট্রোলে রেশমি প্যাটার্নের
মেয়েটা আমার কবিতা পড়ে না
ঝানু তিরকিত আর তার আম্মা
আমার কবিতা পড়ে না

পীন বুকের কিরঘিজ ছুঁড়ি আদেলেত
সে ঘুড়ীর দুধ দোয়ায়
সে ঘুড়ীর দুধ গেঁজিয়ে আইগার বানায়
আমি সময়ে হেলান দিয়ে সাদা টোকো আইগার খাই
আর সকাল থেকে জোছনা অব্দি নেশা করি
কুচুটে ছুঁড়ি আদেলেত আমার কবিতা পড়ে না

আমি যেন সেই নিরক্ষর গান
মানুষের স্মৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে
মানুষ হয়ে গেছি

আকাশ থেকে আমায় পেড়ে
মগজ থেকে আমায় পেড়ে
কেউ আর শুদ্রাগায় বসাচ্ছে না
---
অনুবাদকের নোটঃ (আইগার= ঘুড়ী (Mare)-এর দুধ থেকে প্রস্তুত মদ শুদ্রাগা= তিন তার বিশিষ্ট বাজনা। জাপানি বাদ্যযন্ত্র শামিসেন-এর সাথে মিল আছে)

তদোগেন গিরতের কবিতা- ১০

চাঁদের আলোয় খরগোশগুলো খেলছে
আমি ওদের বিষণ্ণতা বলে জানি
চাঁদের আলোয় ছেয়ে নেকড়ের থাবা
আমি ওকে বিষণ্ণতা বলে জানি
হ্রদের ওপারের মিনারের একলা আলো
ওকেও বিষণ্ণতা বলে মনে হয়
আয়নায় এক ঝলক আমায় থামিয়ে দেয়
আর মাঝরাতের দরজায় চেস্টনাট গাছের
ছায়া আছড়ে পড়ে

আমার খোলা মাথার ওপর
চোখের ভেতর বরফকুচি
আমার বিষণ্ণতা গলে যাওয়া বরফকণা

বরফকুচির বিষণ্ণতা আমি


তদোগেন গিরতের কবিতা- ১১

তদোগেন আমায় ভয় লাগে
পোড়ো বিকেলে যখন আমার ছায়া লম্বা
হতে হতে মাঠ পেরিয়ে স্প্রুসের বনে ঢুকে যায়
জমিতে নিড়েন দিতে দিতে যখন পাঁচফুটিয়া
তোঘেমুর আচমকা এক বিশ ফুটের দানো হয়ে ওঠে
ওর হাতের নিড়ানি যখন দেগেই বুড়োর আপেল
গাছের মুড়ো ছাড়িয়ে যায়
আমার ভয় লাগে

যে সব বাজারের শব্দ দিনের বেলা ঝাঁট
দিয়ে জমা করি, রাত নামলে তারা
বোড়া সাপ হয়ে ওঠে
কবজি পেঁচিয়ে ধরে, ডাঁসে
আমার রক্ত হিম হয়ে যায়

ফোন দোকানের বুগোতান বলেছিল
পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে
এই ইন্টারনেটের যুগে
দু’জন মানুষের যোগাযোগের মধ্যেই
তৃতীয় চারজন বাসা বাঁধে, বাগান করে, বেঁচে বর্তে থাকে

আমার ভয় লাগে
আমি ক্ষুদ্র মানুষ তদোগেন
আমার কবিতার ভেতরে কুঁকড়ে মুকড়ে
ছারপোকার কামড় খাই সারা রাত
দূরত্ব ছাড়া আমার আর কিচ্ছু নেই


তদোগেন গিরতের কবিতা- ১২

তুমি নাদা পেটের ঘোড়া
আর তুমি চকিতপবন ঘোড়া
যতই তুমি দৌড়াও
পৌঁছেছ তুমি তদ্দূরই
যদ্দূর পায়ের ছাপ তোমার

আমার মাঝবয়েস বলে-- তদোগেন
চন্দনবনে চল
চন্দনবন চোদ্দহাজার মাইল
জি-আন আর চংগিং ঘুরে, ইয়াঙ্গন ঘুরে, ভুটান পার করে
তবে সেই চন্দনবনের দেশ

এপ্রিলে পাতা ধরে আর চন্দনের
সুবাস আটকে থাকে হিমে, বল্লম বেঁধা ট্রাউটের মোচড়ে

তথাগত আমার পায়ের আওয়াজ
কবে ওই বনে বাজবে?


তদোগেন গিরতের কবিতা- ১৩

আমায় সব্বাই যোগাযোগের কথা শোনায়
মেরুন উর্দি ডাকপিওন আসে ফি হপ্তায়
কেরুলেন নদী পেরিয়ে
সোঁতা পেরিয়ে
একচিলতে টলোমলো কাঠের সাঁকো পেরিয়ে
ওর কদমছাঁট চুলে জরি-পাড়ের টুপি

আমি দেখি ওই সাঁকো কখন শেকল হয়ে গেছে
ওর যাওয়া আর আসার ছন্দকে বেঁধে ফেলেছে
ক্রমাগত এই যাতায়াতে
ওর উর্দি ওর বুলি ওর টুপি
কখন মাঝদুপুরের মত ফটফটে হয়ে ওঠে
আমার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়

আমি বৃথাই ওদের বোঝাই
পরিচয় আর ঠিকানা ছাড়া যোগাযোগ হয় না
আর যাযাবরের পরিচয় তো তার গোলোস জুতোর নীচে

উট আর বরার বিষ্ঠা ঝেড়ে ফেলে
হেমন্তের আভা ঝেড়ে ফেলে
চুল থেকে স্তেপের কুটো আর বনের বদবু মুছে ফেলে
ঐ সরু সাঁকো বেয়ে কারো বুকে সটান
ঢুকে যাওয়ার জন্য আমি জম্মাইনি


তদোগেন গিরতের কবিতা- ১৪

বালকের বিস্ময়বোধের প্রতি
সমবেদনা রয়েছে আমার তথাগত
তবু আমি ঊরুসন্ধির চোখে জল
দেখে শিউরে উঠি না

মরুঝড়ে উড়ে যাচ্ছে
ইয়ুর্ত তাঁবু আমার
উটগুলো মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে
আপেলফুলের দিন শেষ হলে
পৃথিবীতে আপেলগোটারা বেড়ে ওঠে

প্রতীকবিবর্জিত
জলের কাছে অভ্যস্ত জিভ
ও শরীর নিয়ে আমি ক্রমে
এগোতে পিছোতে থাকি

বিস্ময় তোমারই আস্ত্রাকান
কথাও আমি ভুলব না


তদোগেন গিরতের কবিতা-১৫

যখন ওরা ছুরি চালাল
আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওরা
আমার ভেতর উলান বাটোরের ঘিঞ্জি
গলি, সিনেমা হল, চর্বি সমেত তুর্কী কাবাব,
মদের দোকান ঢুকিয়ে দিল
আমার ভেতরে রাত নামিয়ে দিল
গলির মোড়ে ঝুলিয়ে দিল গ্যাসলাইট

আমি জানি ওরা আমায় ভালোবাসে
আমি জানি ওরা আমায় জুয়ার টেবিলে
শুইয়ে বুকের ওপর প্লাস্টিকের টেবিলক্লথ
পেতে সারারাত পোকার খেলবে
অন্তত যতক্ষণ না পুলিশ এসে তুলে দিচ্ছে ওদের


তদোগেন গিরতের কবিতা-১৬

ওদের গায়ে তিন হাত লম্বা লম্বা কাঁটা
এমন কী পিঠ ও গলার সন্ধিতে
ওরা ঘাড় ঘোরাতে পারে না
কাঁটা ভেঙ্গে গেলে যন্ত্রণায় চিৎকার করে
কেলে হাঁড়িতে মুখ ভরে বাঘ ডাকে
পুরো উলান বাটোর বারবার কেঁপে ওঠে মাঝরাতে
আমরা জানি, এই অঞ্চলে বাঘ কোনদিনই নেই
বড়জোর তুষার চিতাতবু আমরা ভয় পাই
মনের বাঘকে ভয় পাওয়াই নিরাপদ

ওরা কবি
ওই কাঁটাই ওদের বর্ম
ওরা কবি, ওরা লম্বা বাঁকা তলোয়ার
একে অপরের খাপে ঢুকে
ওই দ্যাখো, ওরা ঘাড় শক্ত রেখে ঘুমিয়ে রয়েছে

তদোগেন গিরতের কবিতা-১৭

বুলগার তাঁবুগুলো হাওয়ায় দুলছে
বুলগারগুলো বেহদ ভুক্কড়
ওন্দোরহানের উট খায়, ভেড়া খায়
সকালে ওদের প্লেটে ডবকা সসেজ
সন্ধ্যায় জারানো হেরিং
শালাদের মঙ্গোল ভোদকা রোচে না
তো সোফিয়া থেকেই নিয়ে আসে


কাউন্টেস ভেরা মারকোভা
আজ সোফিয়া থেকেই আসছেন
কাউন্টেস দেখতে শুনতে তুখোড়
কানে হীরের অবতংস
কাউন্টেস প্রতিবারই আমার জন্য
নিয়ে আসেন
কিছু প্রাণবন্ত কমলালেবু 


আজ আমি ভেজা ও গভীর ওভারকোটে
তাঁর কমলালেবুদের জন্য
কাঁপতে কাঁপতে অপেক্ষা করছি


গেলবার উষ্ণ ছিল হাতের তালু
কমলালেবুরা ছিল অপূর্ব শীতল


তদোগেন গিরতের কবিতা-১৮
আমি যখন কোবে যাই
তখন সেখানে ভূমিকম্প হয়নি
বসন্তের দিনকালে, সাদা পোষাকের
আমি বাসডিপোর ধারে ম্যাগনোলিয়া
ফুলের হাল্কা গোলাপি রঙ দেখেছি
ঝাড়া দু’ঘন্টা ধরে


ছোট্ট বাঁধানো মাছের পুল
কমলা, রূপোলি ম্যানিলা কার্প
আমার খিদে পেলে মোড়ক থেকে
সুশি খুলে খেয়েছি
প্লেট ও জলের মাছ এই দুই সত্যকে
উপভোগ করতে করতে


আগামী বছর ক্যালিফোর্ণিয়ার
উপকুলে যাব, যদি হাঙ্গরের পেটে যাই
তথাগত, আমি সেই তৃতীয় সত্যকেও
যেন উপভোগ করতে পারি